ভুল করে খেয়ে ফেললে কি রোযা ভাঙবে না?
ইমাম মালিকের মদীনার মাযহাব অনুযায়ী কেন কাযা আদায় করতে বলা হয়?
মদীনাবাসীর আমল ও মালিকি মাযহাব অনুযায়ী, রোজা রেখে কেউ ভুল করে খেয়ে ফেললে, রোজা ভেঙে যাবে এবং কাযা আদায় করতে হবে!
অনেকের ধারণা, আমরা কোন উসুলের ধার ধারি না, কোন বুদ্ধিবৃত্তিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে না গিয়ে কেবল মনের ইচ্ছামত আলেমদের মত চুজ করি। তাদের ধারণা কোন মতকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে সেই মতের ইলমী শক্তিমত্তা আমাদের কাছে কনসার্ন নয়, কেবল সেই মতের প্র্যাকটিকালিটি ও কনভিনিয়েন্স-ই আমাদের একমাত্র মাথাব্যাথা। বাংলাদেশের মালিকি মাযহাবের সাথে যুক্ত ভাইদের ব্যাপারে এমন সরলীকৃত চিন্তার মূল কারণ হল, আমাদের মতামতগুলোকে কেবল উপসংহারে দিক থেকে দেখা, আমাদের মত বিনির্মাণের সিস্টেমেটিক প্রসেসটা ইগনোর করা। এ যেন পানিতে ভাসমান আইসবার্গের ওপরের অংশটুকু দেখে একেই আইসবার্গের সবটুকু ভেবে বসা।
আমি তাদের সবাইকে দোষও দেই না। কারণ তাদের প্রচ্ছন্ন ধারণা হচ্ছে, যেই মত যত কঠিন, সেই মতের ইলমী ভিত তত মজবুত। এই পূর্বানুমান ত্যাগ না করলে আসলে আপনারা কখনোই আমাদের প্রতি ইনসাফ করতে পারবেন না। কোরআন সুন্নাতে বারবার এসেছে, এই ধর্মকে সহজ করে আল্লাহ পাঠিয়েছেন, এমনভাবে পাঠিয়েছেন যাতে মানুষের জীবন সংকটময় হয়ে না ওঠে। স্বাভাবিক ও ন্যাচারাল জীবনযাপনের সাথে যেই মত যত বেশি সামঞ্জস্যপূর্ণ, সেই মতের পক্ষেই ইলমী দলিল সবচেয়ে শক্তিশালী থাকাই মূলত পূর্বানুমান হওয়া উচিত ছিল।
কিন্তু একটা কথা না বললেই নয়। কোন মত অন্য মতের চেয়ে সহজ মানেই সেই মত শক্তিশালী, তা সর্বাবস্থায় জরুরি না। বরং এমন সহজ মতই বাস্তবে শক্তিশালী হয়, যেটা দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ। রোজা রেখে ভুল করে খেয়ে ফেললে রোজা ভেঙে যায় কিনা এটা এই জাতীয় কোন প্রসঙ্গ নয়। কারণ মানুষ প্রতিদিন ভুল করে না। ভুল করলেও সেটা বড়জোর একমাসে এক-দুইবার করবে। তো এই ভুল বশত খেয়ে ফেলার কারণে তাকে যদি ভবিষ্যতে কাযা আদায় করতে হয়, তবে এটা এমন কোন বিষয় না, যার জন্য মানুষের জীবনযাত্রা আটকে যাবে।
অনেকেই ভাবেন, মালিকি মাযহাবের এই মতটা দলিলের দিক থেকে দুর্বল। অথচ উসুল ও কাওয়াইদের কনসিস্টেন্সির দিকে লক্ষ্য করলে উল্টোটাই বরং বলতে হয়। চলুন, এটা নিয়ে কিছু কথা বলি।
১। সর্বসিদ্ধ উসুল অনুযায়ী শরীয়তের হুকুম দুই প্রকার। হুকুমে তাকলিফি — যা বান্দার কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ ও নির্ধারণ করে, করণীয়-বর্জনীয় ঠিক করে দেয়। ওয়াজিব, মুস্তাহাব, মুবাহ, মাকরুহ, হারাম এই জাতীয় হুকুম।
আরেক প্রকারের হুকুম আছে — হুকুমে ওয়াদই বলে একে — যা বান্দার করণীয় বা বর্জনীয়র যুক্ত না। বরং এটা হল সিগন্যালের মত। যেমন: সূর্য ডুবে গেলে মাগরিবের ওয়াক্ত শুরু হবে — এটা হুকুমে ওয়াদই। এখানে আপনার ইচ্ছা, অনিচ্ছার কোন বিষয় নেই। কোন কাজ সহিহ (শুদ্ধ/সিদ্ধ) বা নাফিয (উত্তীর্ণ) গণ্য করা হবে নাকি ফাসেদ (অশুদ্ধ/অসিদ্ধ) বা বাতিল (অনুত্তীর্ণ) হবে — সেটা আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছা, সচেতন-অচেতন, স্বজ্ঞানে-অজ্ঞানের ওপর নির্ভর করে না।
২। যেকোন ইবাদত সহিহ ও নাফিয হবার জন্য সে ইবাদতের রোকন না মূল ভিত্তিগুলো পূরণ করতে হবে। কারণ এই রোকনগুলো হচ্ছে, সেই ইবাদতের ডিফাইনিং বৈশিষ্ট্য। এর কোন একটা মিস হলে, সেই ইবাদতের মূল সংজ্ঞাটাই আর ঠিক থাকে না। রোযার এমন একটি রোকন হল — “আল ইমসাক” বা নিজেকে বিরত রাখা। নামাজের ক্ষেত্রে উদাহরণ দিলে, রোকন হল শরীর পাক হওয়া। ধরুন, আপনি ভুলে ওযু ছাড়া নামাজ পড়ে ফেললেন, আপনার কি সেই “নামাজ”, নামাজ হিসেবে কাউন্ট হবে? হ্যাঁ, আপনি ওযু না থাকুক, যেহেতু কোরআন পড়েছেন, তসবিহ ও যিকির পাঠ করেছেন, দোয়া ও দরুদ পড়েছেন, তাই আপনার এই কাজগুলো অবশ্যই সোয়াবের দাবিদার, কিন্তু ওযু না থাকার কারণে একে নামাজ বলা যাচ্ছে না। সুতরাং আপনাকে ওযু করে পুনরায় নামাজটা পড়তে হবে।
আরবিতে সাওম শব্দের অর্থই হচ্ছে নিজেকে বিরত রাখা। শরয়ী পরিভাষায়, স্পেসিফিকলি খাদ্য-পান এবং যৌনতা থেকে নিজেকে বিরত রাখা। এখন কেউ যদি নিজেকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়, তবে সে রোযার অরিজিনাল ডেফিনিশনকে লঙ্ঘন করছে। এখন সে এটা ভুল বশত অনিচ্ছায় করেছে কিনা সেটা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়। প্রাসঙ্গিক হল, যে ব্যাক্তি নিজেকে খাদ্য, পানীয় ও যৌনতা থেকে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়, তার ব্যাপারে সাওম শব্দটা প্রযোজ্য হয় কি হয় না। উত্তর: হয় না।
যেহেতু রোযা উত্তীর্ণ নাকি অনুত্তীর্ণ এটা হুকুমে ওয়াদ’ই এর অন্তর্ভুক্ত। আর উত্তীর্ণ হবার জন্য যেহেতু নির্দিষ্ট শর্ত আছে, তাই সেটার ব্যত্যয় ঘটা সত্ত্বেও উত্তীর্ণ বলা চলে না।
৩। উপরে যে দুইটা পয়েন্ট আমরা উল্লেখ করলাম, সেটা হচ্ছে, আলোচ্য মাসআলায় মালিকি মাযহাবের অবস্থানের মূল বেসিস। এই লেখাটা পড়তে পড়তে যদি আপনার মাঝে উসখুশ তৈরি হয়, বুখারিতে বর্ণিত আবু হুরায়রার হাদীসের কী হবে? হাদীস থাকতেও এত ভূমিকা মোকদ্দমা কেন? — তবে এর জবাবও আমাদের আছে।
দেখুন, ইসলামী শরীয়ত একটা সুসংহত আইনি কাঠামো – এখানে বিক্ষিপ্তভাবে কিছু হয় না। একটা সুনিয়ন্ত্রিত কাঠামো দ্বারা ফিকহ বা আইনশাস্ত্রের বুনট রচিত হয়েছে। এই কাঠামো বা কাওয়ায়েদগুলো আমাদের আগে বুঝতে হবে যার ওপর এই গোটা শাস্ত্র দাঁড়িয়ে আছে। তারপর এর আলোকে সামগ্রিকভাবে অন্য সকল বিষয়কে বুঝতে হবে। এটাকে বলা হয়, কিয়াসে কুল্লি বা সামগ্রিক তুলনা ও সামঞ্জস্যতা। এটাই সামগ্রিক সামঞ্জস্য ও সঙ্গতি-ই সৌন্দর্য। আর এই কিয়াসে কুল্লির অবস্থান জ্ঞানতাত্ত্বিক মানদণ্ডে, স্বাভাবিকভাবেই একক সূত্রে বর্ণিত (খবরে আহাদ) হাদীসের ওপরে থাকবে।
দ্রষ্টব্য: আমরা কিয়াসে জুযই নিয়ে কথা বলছি না যেখানে বিচ্ছিন্ন ও শাখাগত বিষয়ে তুলনা করা হয়। আমরা বলছি ফিকহ বা আইনশাস্ত্রের ওভারআর্চিং স্ট্রাকচার বা কাঠামোগত সাযুজ্য নিয়ে।
খবরে ওয়াহেদকে কেন এর নিচে স্থান দিতে হবে? এর উত্তর হল, একক সূত্রে বর্ণিত যেকোন কথার ব্যাপারে শতভাগ আস্থা ও নির্ভরতা অর্জন করা যায় না। হাদীস শাস্ত্রবিদ সকলে একমত যে, একটা খবরে ওয়াহেদ হাদীস সহীহ হলেও সেটা নিজস্বগুণে অকাট্য দলিল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হয় না। কারণ একক ও বিচ্ছিন্নভাবে আগত এসব বর্ণনাসূত্রের ব্যাপারে আশঙ্কা থেকেই যায়। কোথাও কেউ যদি ভুল করে ফেলেন? কিংবা রাসূলের কোন একটা কথার একাংশ যদি বাদ দিয়ে বসেন? কিংবা নিজের ভাষায় রাসূলের কথা বোঝাতে গিয়ে যদি বর্ণনাকারীর দিক থেকে ভুল হয়ে যায়? রমজান মাসে ভুল করে দিনের বেলায় যদি খাবার খেয়ে ফেলা সম্ভব হয়, তবে হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে কোন না কোন ত্রুটিবিচ্যুতি চলে আসা অস্বাভাবিক কিছু নয়। বিশেষ করে, যখন সেই বর্ণনার পক্ষে শাহেদ বা সমর্থক অন্যান্য বর্ণনা না থাকে।
বুখারীতে উল্লিখিত আবু হুরায়রার যে হাদীসটির ওপর নির্ভর করা হয়, তার পক্ষে সমর্থক অন্য কোন সাহাবীর হাদীস নেই। উম্মে ইসহাক নামক এক নারী সাহাবীর হাদীস আছে, কিন্তু সেটা গ্রহণঅযোগ্য দুর্বল, তাই শাহেদ হিসেবে ধর্তব্য নয়। দেখুন, আমরা বলছি না যে, আবু হুরায়রা এককভাবে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন বলেই এই হাদিসকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে হবে। বরং আমরা বলছি যে, একক বর্ণনা হবার কারণে এর জ্ঞানগত শক্তিমত্তা শরীয়তের প্রতিষ্ঠিত সামগ্রিক নীতিমালা বা কাওয়ায়েদে কুল্লিয়া’র মোকাবেলায় নিম্নপর্যায়ের হবে। অর্থাৎ যদি এই দুইয়ের মাঝে কখনো সংঘাত দেখা দেয়, তবে প্রতিষ্ঠিত নীতিমালা নিজ জায়গায় ঠিক রেখে খবরে ওয়াহেদ হাদীসকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে, যা কাওয়ায়েদের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হয়।
৪। এবার আসুন, আবু হুরায়রা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) হাদিসটা বিশ্লেষণ করা যাক। বিরোধীদের দাবি এই হাদীস থেকে তারা জানতে পেরেছেন, ভুল করে রোজা অবস্থায় খেয়ে ফেললে, তার রোজা ভাঙবে না, ফলে তাকে কাযা আদায় করা লাগবে না।
অথচ হাদীসের শব্দগুলো পর্যালোচনা করলে আমরা এমন কোন স্পষ্ট ইঙ্গিত পাই না। হাদীসের শব্দগুলো নিম্নরূপ:
মুহাম্মদ বিন সিরিন বলেন, হযরত আবু হুরায়রা বলেছেন, নবীজী এরশাদ করেছেন —
من نسي وهو صائم، فأكل أو شرب، فليتم صومه؛ فإنما أطعمه الله وسقاه
যে রোজা রেখে, ভুল করে খায় বা পান করে, সে যেন তার সাওমকে (বিরত থাকা) পূর্ণ করে। তাকে তো আল্লাহই খাইয়েছেন ও পান করিয়েছেন।
এই হাদীসে কোথাও কিন্তু রোযার শুদ্ধতা নিয়ে আলাপ নেই। কোথাও বলা নেই যে, কাযা আদায় করা লাগবে না। (দারাকুতনির উল্লিখিত এক বর্ণনায়, “কাযা নেই” এই অতিরিক্ত কথাটি এসেছে। যা এই হাদীসের প্রতিষ্ঠিত বর্ণনার বিপরীত একটি শায বা বিচ্ছিন্ন একটি বর্ণনা। অধিকতর সম্ভাবনা এটা আবু হুরায়রার কথার অংশ নয়, বরং পরবর্তী বর্ণনাকারীদের কোন একজনের ব্যক্তিগত ব্যাখ্যা, যা হাদীসের মূল পাঠের সাথে চলে এসেছে। একে মুদরাজ ফিল মতন (পাঠে অনুপ্রবিষ্ট) বলে। সুতরাং এই অতিরিক্ত কথাটি নির্ভরযোগ্য নয়।)
উপরোক্ত হাদীসে করণীয় হিসেবে কেবল বলা হয়েছে, রোজা অবস্থায় কেউ খেয়ে ফেললে সে যেন শেষ পর্যন্ত খাদ্য, পানীয় এবং যৌনতা থেকে বিরত থাকে। মাঝখানে যেটা ঘটেছে সেটাকে অজুহাত হিসেবে যেন গ্রহণ না করে। আর ভুল করে ঘটিয়ে ফেলা এই কাজের কারণে যেন মনোবেদনা বা হতাশার শিকার না হয় সেই জন্য একটা সান্ত্বনা বাক্যও তিনি বলেছেন “তাকে তো আল্লাহই খাইয়েছেন ও পান করিয়েছেন।”এই ভেবে যেন সান্ত্বনা গ্রহণ করে যে, এই কাজে তার হাত ছিল না। তাকদীরে এই সময়ে তার জন্য খাওয়া লেখা ছিল, তাই খেয়ে ফেলেছে। এই সান্ত্বনাবাক্য থেকে যেটা বোঝা যাচ্ছে, ভুল করে খেয়ে ফেলা কোন অপরাধ নয়। সুতরাং এর জরিমানা বা কাফফারা তাকে দিতে হবে না। আর এই কারণে ইচ্ছাকৃত রোযা ভেঙে ফেললে ব্যাক্তিকে কাযার পাশাপাশি কাফফারা দিতে হলেও, এই ব্যাক্তির জন্য কোন কাফফারা নেই।
এই হাদীস থেকে এর বেশি কিছু সরাসরি বের করা আসলে সম্ভব নয়। যদি কেউ কিছু বের করেও তবে সেটার একাধিক বিকল্প ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব হবে। আর উসুলে ফিকহের প্রসিদ্ধ রুল হচ্ছে, “ইযা তাতাররাকাল ইহতিমাল, বাতালাল ইস্তিদলাল” অর্থাৎ আপনি যেই ব্যাখ্যাকে যুক্তি হিসেবে দাঁড় করাচ্ছেন, সেই ব্যাখ্যার পরিবর্তে যদি কোন বিকল্প ব্যাখ্যা দেয়ার সুযোগ থেকে যায়, তবে আপনার যুক্তিপ্রমাণ নস্যাৎ হয়ে যায়। কারণ সেটা আর অন্য ব্যাক্তির কাছে কনভিনসিং থাকে না। যেমন: কেউ যদি বলেন, নবীজী তো বলেছেন, তার সাওম কমপ্লিট করুক। আর “রোজা কমপ্লিট করা”র ব্যাখ্যা হল “রোযা কমপ্লিট হওয়া”; এর জবাবে বলা যাবে — না, দুটা এক জিনিস নয়। রোযা কমপ্লিট করতে বলার মাধ্যমে নবীজী বলছেন যে, ভুল করে এই কাজ করে ফেলা হলেও যেন শেষ পর্যন্ত পানাহার থেকে বিরত থাকা হয়।
এখন কেউ যদি প্রশ্ন তোলেন, রোজা কাউন্ট না হওয়া সত্ত্বেও কেন রোযা কন্টিনিউ করব? – এর সম্পর্ক রমজান মাসের সাথে। রমজান মাসের দিনের বেলা পানাহার ও যৌনতা নিষিদ্ধ। যদি এই নিষিদ্ধতা অনিচ্ছায় ভঙ্গ করেন, তবে এতে আপনার হাত না থাকার কারণে, কোন দণ্ড ভোগ করতে হবে না। কেবল যেটা ভেঙে গেছে সেটাকে পরে আদায় (কাযা) করে নিলেই হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু যদি ইচ্ছা করে এই নিষিদ্ধতার বিরুদ্ধাচরণ করেন, তাহলে কেবল পুনরায় আদায় করা যথেষ্ট হবে না। পাশাপাশি জরিমানাও গুণতে হবে।
৫। কেউ কেউ আমাদের বলেন, রমজানের দিনের বেলায় যদি কারো স্বপ্নদোষ হয়, তাহলে আমরা কেন বলি না, রোযা ভেঙে গেছে?
উত্তর: রোযার সংজ্ঞায় ফেরত চলুন। রোযা হল পানাহার ও যৌনকর্ম থেকে বিরত থাকা। বিরত থাকা অর্থ নিজ থেকে কিছু না করা। নিজেকে সংবরণ করা। আত্মসংযম করা। হস্তমৈথুনের মাধ্যমে যে যৌনলিপ্সা পূরণ করে তার ক্ষেত্রে বলা যেতে পারে, সে নিজেকে বিরত রাখে নি। কিন্তু যে ঘুমের ঘোরে ছিল এবং তার নিজস্ব কোন ইনভলভমেন্ট ছাড়া যদি কিছু ঘটে যায়, সেখানে বলা যায় না যে, সে নিজেকে বিরত রাখে নি। অর্থাৎ নিজেকে বিরত রাখতে সক্ষম বা ব্যর্থ হয়েছে কিনা এটাই হল রোযার শুদ্ধতা-অশুদ্ধতার মানদণ্ড। ইচ্ছা-অনিচ্ছার সাথে এর কোন সম্পর্ক নেই। বরং ইচ্ছা-অনিচ্ছার সম্পর্ক হল তার এই ব্যর্থতাকে অপরাধ গণ্য করা হবে নাকি হবে না — তা নিয়ে।
৬। এতক্ষণ আমরা ডিফেন্সে খেললাম। এবার আমরা পাল্টা প্রশ্ন করি। ধরুন কেউ ভুল করে রোযা রেখে স্ত্রীর সাথে সহবাস করে ফেলল। তার রোযা কি কাউন্ট হবে?
এখানে কেন “না” বলছেন? এখানেও বলুন, আল্লাহ-ই তাকে দিয়ে সহবাস করিয়েছেন! অনিচ্ছায় বা ভুল বশত কিছু করে ফেলার অর্থ যদি এ-ই হয় যে, এটাকে গণনাতেই ধরা হবে না, তাহলে নামাজের মধ্যে কেউ অনিচ্ছায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়লে নামাজ কেন ভাঙবে? এখানে কেন বলছেন না, “তার কি দোষ? আল্লাহই তো তাকে হাসিয়েছেন!”
কেউ কেউ বলেন, পানাহারের সাথে সহবাসকে মেলানো ঠিক না; কারণ পানাহার লঘু, সহবাস গুরু! এর জবাবে আমরা বলব, এই লঘু-গুরু নির্ণয়ের কোন শরয়ী ভিত্তি নেই। কারণ রমজানের দিনের বেলা ইচ্ছা করে খেলে যেই কাফফারা, ইচ্ছা করে সহবাস করলেও সেই একই কাফফারা। যদি শরীয়তের চোখে পানাহার ও সহবাসের মাঝে কোন বৈষম্য থাকত, তাহলে উভয়ের জন্য ভিন্ন ভিন্ন দণ্ড সাব্যস্ত করা হত।
দেখুন, দোষ থাকা না থাকার সাথে কোন একটা কাজের শুদ্ধতা-অশুদ্ধতার সম্পর্ক নেই – এটা শরীয়তের মূলনীতি। দোষ না থাকার অর্থ হল গুনাহ হবে না। কিন্তু শুদ্ধতার শর্ত বা রোকন ভঙ্গ হলে, সেটাকে শুদ্ধ বলার সুযোগ থাকে না। সুতরাং একটা অস্পষ্ট একক সূত্রের হাদীসকে কেন্দ্র করে, শরীয়তের এই মূলনীতি লঙ্ঘন করার জাস্টিফিকেশন কোথায়?
পরিশেষে, যারা এই মাসআলায় মদীনার মাযহাবের অনুসরণ করেন না, তাদের আমরা সমালোচনা করছি না। এটা স্পষ্ট করে বলতে চাই যে, বাংলাদেশে মালিকি মাযহাব প্রচারের উদ্দেশ্য কখনোই হানাফী কিংবা আহলে হাদীস ঘরানাকে চ্যালেঞ্জ করা নয়। বরং আমরা চাই, জ্ঞানচর্চার প্রসার। মদীনাবাসী সাহাবী, তাবেঈ, তাবে তাবেঈদের আমল কেমন ছিল সেটা জানার মাঝে তো কোন দোষ নাই। মালিকি মাযহাবের মূল কথাই যেহেতু মদীনার আমল। তাই আমরা কেবল মানুষের জন্য মদীনার জ্ঞানের এই দরজাটা উন্মুক্ত রাখতে চাই। এই দরজা দিয়ে কাউকে ধরে-বেঁধে দলভারী করার কোন উদ্দেশ্য আমাদের নেই। আমরা নিজেদের কখনোই আপনাদের প্রতিপক্ষ ভাবি না, আমরা নিজেদেরকে আপনাদের বিকল্প ও সহযোগী হিসেবেই ভাবি। মাহে রমজানের বরকতে আমাদের মাঝে ভ্রাতৃত্ব, সহিষ্ণুতা ও সৌহার্দ্যের বন্ধন আরো মজবুত হোক, নিজেদের মতভিন্নতা সত্ত্বেও একে অন্যকে সম্মান করার মত প্রশস্ত অন্তর লাভ হোক — আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করে ইতি টানছি।