বিয়েতে গানবাদ্য বিষয়ে ইমাম মালিক ও তার ছাত্রদের অবস্থান।
বিয়ের অনুষ্ঠানে ইমাম মালিকের বাদ্যযন্ত্রের অনুমোদন
ইমাম ইবনে রুশদ আল-জাদ্দ (রহিমাহুল্লাহ) এর “আল বায়ান ওয়াত তাহসিল” বই থেকে অনূদিত —
ইমাম মালিককে জিজ্ঞেস করা হয় যদি কোন লোককে অনুষ্ঠানে ডাকা হয় এবং সেখানে সে খেল-তামাশা দেখে, তবে কি প্রবেশ করবে? ইমাম মালিক বলেন, যদি সামান্য বিষয় হয় যেমন দফ ও ঢোল ইত্যাদি যেসব নারীরা বাজিয়ে থাকে, তবে আমি কোন সমস্যা দেখি না।
মুহাম্মদ ইবনে রুশদ বলেন,
ইমাম মালিক অনুষ্ঠান বলতে বিয়ে ও বৌ-ভাতের অনুষ্ঠান বুঝিয়েছেন যেমনটি আসবাগের উদ্ধৃতিতে (সিমা’) এসেছে। কেননা এসব ফূর্তির (লাহু) ক্ষেত্রে রোখসত (ছাড়) দেওয়া হয়েছে যেহেতু এসবের মাধ্যমে বিয়ের ঘোষণা জানানো মুস্তাহাব।
যেমনটি আল্লাহর রাসুল (সা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে যে, “তোমরা বিয়ের ঘোষণা দাও, মসজিদে বিয়ে পড়াও এবং বিয়েতে দফ বাজাও।”
তিনি আরো বলেছেন, “হালাল ও হারামের মাঝে পার্থক্য হল দফ ও আওয়াজ (অর্থাৎ সঙ্গীত)।“
এছাড়াও বর্ণিত হয়েছে, “নবীজী বনি যুরাইক গোত্রের পাশ দিয়ে যওয়ার সময় গান-বাজনা ও খেল-তামাশার আওয়াজ শুনতে পান। তিনি জিজ্ঞেস করেন, এখানে কী হচ্ছে?” তারা বলে, “অমুকের বিয়ে হচ্ছে, ইয়া রাসুলাল্লাহ!” তিনি বলেন, “হ্যাঁ, এটাই বিয়ে। ব্যাভিচার নয়। বিয়ে বলে বিবেচ্য হবে না যতক্ষণ দফের আওয়াজ না শোনা যাবে কিংবা ধোঁয়া (রান্নার) দেখা না যাবে।“
আমার জানামতে আহলুল ইলম সকলেই বিয়েতে দফ বাজানোর অনুমতি দিয়েছেন। দফ হল চালুনির (গিরবাল-غربال) মত বাদ্যযন্ত্র। তবে ঢোল (কাবার-كبر) ও হ্যান্ড-ড্রাম (মিযহার-مزهر) বাজানোর ব্যাপারে তিনটি মত পাওয়া যায়—
১ - এদেরকে দফের সমপর্যায়ে গণ্য করা হবে এবং বিয়ের অনুষ্ঠানে এদের ব্যবহার জায়েয—এটা ইবনে হাবিবের মত।
২ - এর কোনটাই দফের সমপর্যায়ের বিবেচনা করা হবে না এবং বিয়ে কিংবা বিয়ের বাইরে ব্যবহার জায়েয বলা হবে না—এটা আসবাগের মত যা তিনি এই কিতাবে এর পরই উল্লেখ করেছেন। আর এই মত অনুযায়ী সামনে ইবনুল কাসিম থেকে সাহনুনের উদ্ধৃতি আসবে লেনদেন অধ্যায়ে যে, "ঢোল বিক্রি করা হলে সেই লেনদেন অকার্যকর হবে এবং বিক্রেতাকে শাসন করা হবে"। যেহেতু মিযহার ঢোলের চাইতেও বেশি ফুর্তিদায়ক তাই এর ক্ষেত্রেও একই বিধান আরো বেশি করে প্রযোজ্য হবে।
৩ - দফের যে বিধান সেটা ঢোলের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হবে, তবে মিযহারের ক্ষেত্রে না—এটা ইবনুল কাসিম থেকে আগত ভিন্ন আরেকটি বর্ণনা যা এই কিতাবে উল্লেখিত হয়েছে। আর লিখিত উদ্ধৃতি (রসম) মোতাবেক, যদি এটা ওসিয়তের অধ্যায়ে ঈসা’র উদ্ধৃতি হয়ে থাকে, তবে তিনি চুরির অধ্যায়ে যে বলেছেন “ঢোলের মূল্য অনুযায়ী চোরের হাত কাটা হবে” সেটা সহিহ হবে।
এদিকে ইবনে কিনানাহ “আল মুদাওয়ানা”তে বিয়ের অনুষ্ঠানে সানাই (বুক-بوق) বাজানোর অনুমতি দিয়েছেন। এর ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, তিনি এমন সানাই ও বাঁশির (যাম্মারা-زمارة) কথা বলেছেন যা মানুষকে ফূর্তিতে বেসামাল করে দেয় না। আল্লাহ ভাল জানেন।
এছাড়াও এসমস্ত বিষয়ের জায়েয হওয়া কোন পর্যায়ের জায়েয এই নিয়েও মতভেদ হয়েছে। এক মতে, এটা এমন জায়েয যা করা কিংবা না করা সমান সমান। অর্থাৎ করলে সওয়াব নেই, না করলে গুনাহ নেই। আর এটাই মাযহাবের মশহুর মত। ভিন্নমতে, এটা হল অনুত্তম পর্যায়ের জায়েয, যা না করা ভালো। সুতরাং এটা করা অপছন্দনীয় যেহেতু না করলে সওয়াব আছে, তবে করলে দোষ কিংবা শাস্তি নেই। এটা আল-মুদাওয়ানাতে ইমাম মালিকের মত। তিনি এই অর্থে বিয়েতে দফ ও বাদ্যযন্ত্র মাকরুহ বলেছেন।
এছাড়াও এটা কি নারী-পুরুষ সবার জন্য জায়েয কিনা এই নিয়ে মতভেদ আছে। আসবাগের উদ্ধৃতি অনুযায়ী এটা নারীদের জন্য কেবল জায়েয। পুরুষের জন্য এসব কাজে অংশ নেয়া কিংবা উপস্থিত হওয়া জায়েয না। কিন্তু মাযহাবের মশহুর মত অনুযায়ী, এসবে অংশ নেওয়া ও উপস্থিত হওয়া পুরুষ-নারী উভয়ের জন্যই জায়েয। এটা ইবনুল কাসিম থেকে আসবাগ উদ্ধৃত করেছেন, যদিও তার নিজস্ব মত এর বিপরীত।
নারী-পুরুষের উভয়ের বৈধতার মতটিই ইমাম মালিকের মত, তবে তিনি সম্মানী মানুষের জন্য এসব খেলতামাশায় অংশ নেওয়া অপছন্দ করেছেন। এটি মালিক থেকে ইবনে ওয়াহবের বর্ণনা যা আসবাগ উদ্ধৃত করেছেন। পরিশেষে যেসব ফুর্তি (লাহু) বিয়েতে করা জায়েয না, সেসব অনুষ্ঠানে দাওয়াত পেলে উপস্থিত হওয়াও জায়েয না।
সূত্র: আল-বায়ান ওয়াত-তাহসীল, খণ্ড ৪, পৃষ্ঠা ৪৩১-৪৩২।
পরিচিতি:
ইবনুল কাসিম: ইমাম মালিকের মিসরি ছাত্র। ইমাম মালিকের ছাত্রদের প্রধান।
ইবনে ওয়াহব: ইমাম মালিকের মিসরি ছাত্র, ইমাম মালিক থেকে সবচাইতে বেশি হাদিস বর্ণনাকারী।
ঈসা - ঈসা বিন দীনার। ইমাম মালিকের শীর্ষস্থানীয় মাদানী ছাত্রদের একজন।
ইবনে কিনানা - উসমান বিন ঈসা বিন কিনানা। ইমাম মালিকের শীর্ষস্থানীয় মাদানী ছাত্রদের একজন।
সাহনুন - ইবনুল কাসিমের প্রধান ছাত্র। তাকে দিয়েই ইবনুল কাসিম আল-মুদাওয়ানা লেখান।
আসবাগ - ইবনুল কাসিম ও ইবনে ওয়াহবের বিখ্যাত ছাত্র।
ইবনে হাবিব - আব্দুল মালিক বিন হাবিব আল-আন্দালুসি। ইমাম মালিকের ছাত্রদের ছাত্র। আল-ওয়াদ্বিহা গ্রন্থের রচয়িতা যার স্থান আল-মুদাওয়ানার পরেই।

