গত কিছুদিন আগে শায়খ হাসান সাক্কাফের তিনটি নতুন লেকচার রিলিজ হল ইউটিউবে, আসারি-সালাফি আকিদার পূর্বসূরীদের বক্তব্য ও মতামত বিশ্লেষণ নিয়ে। প্রথমটা ছিল আসারিদের মান্যবর ইমাম, বারবাহারি ও তার "শারহুস সুন্নাহ" বই নিয়ে। দ্বিতীয়টি আরেক আসারি ইমাম মুহাম্মদ বিন উসমান বিন আবি শায়বা ও তার লেখা "কিতাবুল আরশ" বই নিয়ে। এই তো আজ বিকেলেই লেকচারটা শুনছিলাম। আসারি আকিদার নামে হাজার বছর আগে লিখিত এইসব বইতে আল্লাহর শানে যেসব তাশবিহ ও তাজসিম পূর্ণ কথাবার্তা আছে সেগুলো নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে পুনরায় জানলাম। বারবাহারির শারহুস সুন্নাহ বইটা হাল যুগের সালাফিদের ইমাম রবি আল মাদখালি নব্বইয়ের দশকে ব্যাপক প্রচলন ঘটান। তো এই বইতে বারবাহারি বলেন, কোন ব্যাক্তির সামনে যদি “আসার” (বর্ণনা) পেশ করা হয়, কিন্তু সে কোরআনের দোহাই দিয়ে আসার মানতে অস্বীকার করে, তবে সে একজন যিন্দিক! আসারি আকিদার আকর বইগুলোতে দেখবেন নবি, সাহাবি, তাবেয়ি, তাবে তাবেয়িদের বিভিন্ন আসার বা বর্ণনা দিয়ে পরিপূর্ণ। তো এমনই একটি বই হল মুহাম্মদ বিন উসমান বিন আবি শায়বার লেখা “কিতাবুল আরশ”। তো এই বইতে তিনি নবি ও সাহাবিদের নামে এমন সমস্ত আসার নিয়ে এসেছেন যেগুলোতে আল্লাহর নামে যেসব বক্তব্য আছে তা চিন্তা করলেই গায়ের রোম দাঁড়িয়ে যায়! এমন একটি উদাহরণ হল নিচের এই বর্ণনা।
عن عَبْدِ اللَّهِ بْنِ سَلَمَةَ قَالَ: أَرْسَلَ ابْنُ عُمَرَ- إِلَى ابْنِ عَبَّاسٍ- يَسْأَلُهُ، هَلْ رَأَى مُحَمَّدٌ رَبَّهُ، فَأَرْسَلَ إِلَيْهِ ابْنُ عَبَّاسٍ: أَنْ نَعَمْ، قَالَ: فَرَدَّ عَلَيْهِ ابْنُ عُمَرَ رَسُولَهُ: أَنْ كَيْفَ رَآهُ، قَالَ: رَآهُ فِي رَوْضَةٍ خَضْرَاءَ رَوْضَةٍ مِنَ الْفِرْدَوْسِ دُونَهُ فِرَاشٌ مِنْ ذَهَبٍ، عَلَى سَرِيرٍ مِنْ ذَهَبٍ، يَحْمِلُهُ أَرْبَعَةٌ مِنَ الْمَلَائِكَةِ، مَلَكٌ فِي صُورَةِ رَجُلٍ، وَمَلَكٌ فِي صُورَةِ ثَوْرٍ، وَمَلَكٌ فِي صُورَةِ أَسَدٍ، وَمَلَكٌ فِي صُورَةِ نَسْرٍ
আবদুল্লাহ বিন সালামা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইবনে উমার ইবনে আব্বাস এর কাছে লোক পাঠিয়ে জিজ্ঞেস করেন, মুহাম্মদ কি আল্লাহকে দেখেছেন? ইবনে আব্বাস তাকে উত্তর দেন, হ্যাঁ দেখেছেন। ইবনে উমার ফের জিজ্ঞেস করেন, কেমন দেখেছেন? ইবনে আব্বাস বলেন, ফিরদাউস এর এক সবুজ বাগানে, তাঁর নিচে ছিল স্বর্ণের পালঙ্ক। আর সেটা বহন করে আছে চারজন ফেরেশতা। একজনের চেহারা মানুষের মত, একজনের চেহারা ষাঁড় গরুর মত, একজনের চেহারা সিংহের ন্যায়, আর আরেকজনের ঈগলের মত!
চিন্তা করা যায়! সুবহানাল্লাহি আম্মা ইয়াসিফুন!
ঠিক এই বর্ণনাটিই আপনি আসারি আকিদার আরো অন্যান্য বইতে পাবেন যেমন ইবনে খুযাইমার রচিত কিতাবুত তাওহিদ (পৃষ্ঠা ১৯৮), আজুররির লেখা ‘আশ শরিয়াহ’ (পৃষ্ঠা ৪৯৪), আব্দুল্লাহ বিন আহমদ বিন হাম্বলের লেখা ‘আস সুন্নাহ’ (পৃষ্ঠা ৩৫), এছাড়াও বায়হাকির রচিত ‘আল আসমা ওয়াস সিফাত’ (পৃষ্ঠা ৫৫৭-৫৫৮)।
মজার বিষয় কী জানেন? আজ রাত্রে, এই কিছুক্ষণ আগেই, কিছু ভাইয়ের সাথে তাওরাত ও বাইবেল নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে নানান কথার সূত্রে Book of Ezekiel এর প্রসঙ্গে চলে আসে। তো উইকিপিডিয়াতে সার্চ করে বাইবেলের এই চ্যাপ্টারের বিষয়বস্তুর ব্যাপারে যা পড়লাম তা দেখে ভারী চমকে গেলাম! আরে বিকেলে তো এই কাহিনীই শুনেছি! আসারি আকিদার নামে এমন জালিয়াতিও যে সম্ভব আমার কল্পনাতেও আসে নাই! আপনারাও দেখুন একটু চোখ বুলিয়ে —
Inaugural vision Ezekiel 1:1–3:27: God approaches Ezekiel as the divine warrior, riding in His battle chariot. The chariot is drawn by four living creatures, each having four faces (those of a man, a lion, an ox, and an eagle) and four wings.
প্রারম্ভিক দর্শন (ইযেকিয়েল ১:১ থেকে ৩:২৭): খোদা ইযেকিয়েলের সামনে আবির্ভূত হন একজন বীরের বেশে, তাঁর যুদ্ধের রথে চড়ে। রথকে টেনে নিয়ে যাচ্ছি চারটি প্রাণী, যাদের ছিল চার রকম চেহারা - মানুষের, সিংহের, ষাঁড়ের এবং ঈগলের। আর ছিল চারটি পাখা।
কী মিল খুঁজে পান? জান্নাতের সবুজ বাগানে স্বর্ণের পালকির ওপর আল্লাহ বসে আছেন আর তার নিচে মানুষ, সিংহ, ষাঁড় ও ঈগলের চেহারার চারজন ফেরেশতা! কি? বাইবেলের ইসলামি ভার্শন, তাই না? আর সেটাও নবিজি ও সাহাবিদের নামে চালিয়ে দেওয়া! নাউযুবিল্লাহ।
আমরা যখন কোরআন-সুন্নাহর ব্যাখ্যায় ইসরাইলিয়াতের বর্ণনার প্রভাবের কথা বলি, তখন অনেকেই ভাবেন, আরে, এসব বর্ণনাতে যেসব শব্দ আছে সেগুলো তো তাওরাত বা বাইবেলে নেই, তাহলে ইসরাইলিয়াত কীভাবে হল? আসল বিষয় হল, তাওরাত ও বাইবেলের কিচ্ছা-কাহিনী যদি গল্পকাররা হুবুহু চালিয়ে দিত তাহলে সেটা মুসলিম সমাজে ধোপে টিকত না। এই কারণে তারা এসব কাহিনীগুলো ইসলামিকরণ করে প্রথমে। মূল ভাবকে ঠিক রেখে ইসলামি ডায়ালগ ও চরিত্র বাছাই করে। এই যেমন এই কিচ্ছাতে নবিজির মেরাজের ঘটনাকে গল্পের পটভূমি বানিয়ে, ইবনে আব্বাস ও ইবনে ওমরকে চরিত্রকে ব্যবহার করে বাইবেলের এই গল্পকে ইসলামি ফ্লেভার দিয়ে আসারি আকিদা নামে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে!
কেউ হয়ত ভাবতে পারেন, জাল-জয়িফ হাদিস তো বিভিন্ন বইপত্রে থাকেই, এটা আর আশ্চর্যের কী! কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে যেই বইগুলোতে আল্লাহর নামে এসব জাল ও বানোয়াট গল্প আকিদা বলে চালানো হয়েছে, সেই বইগুলো আসারিদের কাছে কতটা মূল্য রাখে। আপনি যদি ইবনে তায়মিয়্যাহর মাজমুউল ফাতাওয়া খোলেন এবং আসারি আকিদা জানতে সালাফদের কী কী বই পড়তে হবে তার তালিকা খোঁজেন, তাহলে ঠিক এই বইগুলোর নামই খুঁজে পাবেন। যেমন ইবনে তায়মিয়্যাহ লিখেছেন,
وَالْكُتُبُ الْمَوْجُودَةُ فِيهَا أَلْفَاظُهُمْ بِأَسَانِيدِهَا وَغَيْرِ أَسَانِيدِهَا كَثِيرَةٌ: مِثْلُ: (كِتَابِ الرَّدِّ عَلَى الْجَهْمِيَّة) لِلْإِمَامِ أَبِي مُحَمَّدٍ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ أَبِي حَاتِمٍ وَ(الرَّدِّ عَلَى الْجَهْمِيَّة) لِعَبْدِ اللَّهِ بْنِ مُحَمَّدٍ الجعفي شَيْخِ الْبُخَارِيِّ وَ(الرَّدِّ عَلَى الْجَهْمِيَّة) لِلْحَكَمِ بْنِ مَعْبَدٍ الخزاعي وَ(كِتَابِ السُّنَّةِ) لِعَبْدِ اللَّهِ بْنِ أَحْمَد بْنِ حَنْبَلٍ وَ(السُّنَّةِ) لِحَنْبَلِ ابْنِ عَمِّ الْإِمَامِ أَحْمَد وَ(السُّنَّةِ) لِأَبِي دَاوُد السجستاني وَ(السُّنَّةِ) لِلْأَثْرَمِ وَ(السُّنَّةِ) لِأَبِي بَكْرٍ الْخَلَّالِ وَ(السُّنَّةِ وَالرَّدِّ عَلَى أَهْلِ الْأَهْوَاءِ) لِخُشَيْشِ بْنِ أَصْرَمَ وَ(الرَّدِّ عَلَى الْجَهْمِيَّة) لِعُثْمَانِ بْنِ سَعِيدٍ الدارمي. وَ(نَقْضِ عُثْمَانَ بْنِ سَعِيدٍ عَلَى الجهمي الْكَاذِبِ الْعَنِيدِ فِيمَا افْتَرَى عَلَى اللَّهِ فِي التَّوْحِيدِ) وَ(كِتَابِ التَّوْحِيدِ) لِابْنِ خُزَيْمَة وَ(السُّنَّةِ للطبراني) وَلِأَبِي الشَّيْخِ الأصبهاني وَ(شَرْحِ أُصُولِ السُّنَّةِ) لِأَبِي الْقَاسِمِ اللالكائي وَ(الْإِبَانَةِ) لِأَبِي عَبْدِ اللَّهِ بْنِ بَطَّةَ وَكُتُبِ أَبِي عَبْدِ اللَّهِ بْنِ منده وَ(السُّنَّةِ) لِأَبِي ذَرٍّ الهروي وَ(الْأَسْمَاءِ وَالصِّفَاتِ) للبيهقي وَ(الْأُصُولِ) لِأَبِي عُمَرَ الطلمنكي وَ(الْفَارُوقِ) لِأَبِي إسْمَاعِيلَ الْأَنْصَارِيِّ وَ(الْحُجَّةِ) لِأَبِي الْقَاسِمِ التيمي. إلَى غَيْرِ ذَلِكَ مِنْ الْمُصَنَّفَاتِ
সালাফদের বক্তব্যসমূহ সনদ সহ কিংবা সনদ ছাড়া যে বইগুলোতে পাওয়া যায়, তার সংখ্যা অনেক। যেমন: ইবনে আবি হাতেমের লেখা ‘আর রদ্দ আলাল জাহমিয়্যাহ’, বুখারির শায়খ আব্দুল্লাহ বিন মুহাম্মদ জু’ফির লেখা ’আর রদ্দ আলাল জাহমিয়্যাহ’, এছাড়াও হাকাম বিন মা‘বাদ আল খুযা’ইর লেখা ‘আর রদ্দ আলাল জাহমিয়্যাহ’, আব্দুল্লাহ বিন আহমাদ বিন হাম্বলের লেখা ‘কিতাবুস সুন্নাহ’, ইমাম আহমদের ভাতিজা হাম্বলের লেখা ‘আস সুন্নাহ’, আবু দাউদ সিজিস্তানির ‘সুন্নাহ’, আসরামের ‘সুন্নাহ’, খাল্লালের ‘সুন্নাহ’, খুশাইশ বিন আসরামের ‘সুন্নাহ’, উসমান বিন সাইদ দারেমির ‘আর রদ্দ আলাল জাহমিয়্যাহ’, ইবনে খুযাইমার ‘কিতাবুত তাওহিদ’, তাবারানি ও আবুশ শায়খ ইসফাহানির লেখা ‘সুন্নাহ’, লালকাইর ‘শারহু উসুলিস সুন্নাহ’, ইবনে বাত্তার লেখা ‘ইবানা’, ইবনে মান্দার বইপত্র, আবু যর হারাভির ‘সুন্নাহ’, বায়হাকির ‘আসমা ওয়াস সিফাত’, আবু উমার তালামানকির ‘উসুল’, আবু ইসমাইল আনসারির ‘ফারুক’, আবুল কাসেম তায়মির ‘হুজ্জাহ’ সহ আরো বইপত্র।
তো দেখতেই পাচ্ছেন যে, বাইবেলের ইযেকিয়েলের স্বপ্নকে মেরাজের গল্প বানিয়ে দেওয়া মানুষ, সিংহ, ষাঁড় ও ঈগলের চেহারার ফেরেশতাদের এই বর্ণনা যেসব বইতে বর্ণিত আছে বলে ওপরে উল্লেখ করেছি, তা ইবনে তায়মিয়্যাহর উল্লিখিত তালিকারই অন্তর্ভূক্ত!
আজকে এই পর্যন্তই। আশা করি, ইসরাইলি রেওয়ায়াতের সাথে আসারি আকিদার ঘনিষ্টতা এখান থেকে স্পষ্ট হচ্ছে। এই জাতীয় ইসরাইলিয়াত ভিত্তিক আসার দিয়েই মূলত ঠাসা আসারিদের এইসব বইপত্র। আর এগুলো পড়েই সালাফিদের মনে আল্লাহর ব্যাপারে দেহবাদী ও সাদৃশ্যবাদী আকিদা শক্ত ও পাকাপোক্ত হয়।