(১)
নাজদি মিশনের প্রবর্তক শায়খ মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব (সংক্ষেপে MIAW, মিয়াও) এর সময় থেকে এটা শুরু হয়েছে। এই ওয়াহাবি দাওয়াতের অনুসারীরা তাদের ইমাম মিয়াওকে নবিতুল্য ভাবত। কাদিয়ানিদের চেয়ে এই ফেরকার চিন্তাভাবনা খুব একটা ভিন্ন ছিল না। এই মেসিয়ানিক প্রজেক্ট ওয়াহাবি সক্রিয়তার প্রাণ। তাদের সম্পর্কে যদি আপনাদের কখনো কিছু জানার থাকে সরাসরি চলে যাবেন নাজদিদের বাইবেল "আদ দুরারুস সানিয়্যাহ ফি আজউইবাতিন নাজদিয়্যাহ" বইটাতে। পড়ে দেখবেন শায়খ মিয়াও ও বিন সউদের জেনারেশন থেকে শুরু করে, তাদের ছেলে-পিলে, নাতি-পুতি, তাদের ছেলে-পিলে, তাদের নাতি-পুতি... এভাবে নাজদি দাওয়াতের (ওয়াহাবি-সোউদি জোট) চৌদ্দ গোষ্ঠীর সকল পোপ-বিশপদের আকিদা-বিশ্বাস, যা এখানে অত্যন্ত যত্নের সাথে সংকলন করা হয়েছে।
(২)
সালাফি শব্দটা নাজদি/ওয়াহাবি মিশনের আগেও ব্যবহৃত হত, যেমন ইবনে কাসির কিংবা যাহাবিকে দেখবেন যে, হাম্বলি বা আসারি ধারার আলেমদের ব্যাপারে সালাফি শব্দ ব্যবহার করছেন। কিন্তু, যেভাবে বাংলাদেশের কনটেক্সটে "সুন্নি" বললে ঠিক সুন্নি (আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামাতের অনুসারী) বোঝায় না, বরং বৃহত্তর বেরেলভি ঘরানা বোঝায়, ঠিক তেমনি বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে সালাফি বললে শব্দের ব্যপক অর্থ না বুঝিয়ে, ওয়াহাবি-নাজদি ধারার অনুসারীদের বোঝায়।
(৩)
নাজদি-ওয়াহাবি দাওয়াতের উৎপত্তি কাদের মাঝ থেকে হয়েছে, এই মিশনের প্রধান বিরোধী কোন ধারার আলেমরা ছিলেন, কী ও কাদের নিয়ে তাদের বিতর্ক হত - এই বিষয়গুলো না জানলে নাজদিদের ব্যাপারে সঠিক কোন অ্যাসেসমেন্ট করা সম্ভব না। নাজদি মিশনের প্যাট্রিয়ার্ক শায়খ মিয়াও জন্ম নিয়েছিলেন এক ঐতিহ্যবাহী হাম্বলি পরিবারে, তার শিক্ষাদীক্ষাও সম্পন্ন হয়েছিল হাম্বলি আলেম ও মাশায়েখদের হাতে। শায়খ মিয়াও সর্বপ্রথম তার এই হাম্বলি মাশায়েখদের কাফের আখ্যা দেন, কালেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ'র অর্থ সম্পর্কে তাদের অজ্ঞ-মূর্খ আখ্যা দেন। শায়খ মিয়াও এর সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষও ছিল তার অঞ্চলের হাম্বলি ওলামা-মাশায়েখগণ। আর তাদের সর্বাগ্রে ছিলেন তার বড়ভাই ইমাম সুলায়মান বিন আব্দুল ওয়াহহাব। তিনি শায়খ মিয়াও এর মূর্খতা ও দিশেহারা কথাবার্তাকে চূড়ান্তভাবে খণ্ডন করে বই লিখেছিলেন এবং সেখানে দেখিয়েছেন যে, শায়খ মিয়াও এর কোন কথাবার্তাই হাম্বলি ভাবধারার আলেমদের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না।
(৪)
নাজদি বাইবেলে আপনি অসংখ্য জায়গায় পাবেন যে, যখনই শায়খ মিয়াও এর কাছে তার এই দাওয়াত বা মিশনের জ্ঞানগত ভিত্তি সম্পর্কে জানতে চাওয়া হচ্ছে, তিনি সবাইকে ইবনে তায়মিয়্যাহ ও ইবনুল কাইয়্যিমার বইপত্র রেফার করে বেড়াচ্ছেন। শায়খ মিয়াও থেকে নিয়ে আজতক তার যত অনুসারীরা এই ওয়াহাবিজমে কনভার্ট হয়েছে (জি, কনভার্শন। লিটারেল অর্থে), তারা প্রত্যেকেই এই মিথ্যার ওপর নিজেদের বিশ্বাস ও সক্রিয়তার ভিত্তি স্থাপন করেছে। আর এই কারণেই শায়খ সুলায়মান যখন তার পথভ্রষ্ট ছোটভাইকে ইবনে তায়মিয়্যাহর নাম নিয়ে তার গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ জাস্টিফাই করতে দেখলেন, তিনি তার পুরো বইটি লিখলেন, খোদ ইবনে তায়মিয়্যাহ ও ইবনুল কাইয়্যিমের বক্তব্য থেকে দেখিয়ে দিতে যে শায়খ মিয়াও ইবনে তায়মিয়্যাহকে নিজের মতলব উদ্ধারের জন্য অপব্যবহার করছে, ইবনে তায়মিয়্যাহ যা বলতে চেয়েছেন তা সে তার স্থুলবুদ্ধি দিয়ে আদৌ বুঝতে পারছে না। বরং ইবনে তায়মিয়্যাহর বক্তব্যকে কাটাছেড়া করে ভুল উপায়ে উপস্থাপন করছে।
(৫)
নাজদি মিশনের বিরোধিতা করতে হলে সবার আগে আপনাকে মূলধারার হাম্বলি আলেমদের সাথে তাদের পার্থক্য বুঝতে হবে। তারপর মূলধারার হাম্বলি আলেমরা, যেমন ইমাম সাফফারিনি, যিনি মিয়াও-এর সমকালীন ছিলেন এবং মিয়াও-কে ভ্রষ্ট খারেজি আখ্যা দিতেন) ইবনে তায়মিয়্যাহকে কীভাবে পড়েছেন ও ব্যাখ্যা করেছেন। নাজদি মিশনের মূল অস্ত্র হল তাকফির বা অন্যকে কাফের ঘোষণা করা। ঈমান ও আমলের বোঝাপড়া নিয়ে ইবনে তায়মিয়্যাহর মতামত যদি কেউ সাফফারিনির লাওয়ামে' কিংবা সুলায়মানের সাওয়া'ইক থেকে পড়েন, তাহলে তার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে যাবে, মিয়াও এর ব্যাখ্যা ইবনে তায়মিয়্যাহর বক্তব্যের অপব্যাখ্যা ছাড়া কিছুই না।
(৬)
ইবনে তায়মিয়্যাহ ছিলেন একজন পলেমিক ও দার্শনিক। তিনি প্রতিষ্ঠিত অনেক মতের বিরোধিতা করেছেন, জ্ঞানতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি প্লেটোর ফর্ম থিওরির বিরোধী ছিলেন, নমিনালিস্ট ছিলেন অন্টলজিতে। আল্লাহর যাত ও সিফাত থেকে শুরু করে, ঈমান ও আমলের সংজ্ঞায়ন সবখানে তিনি এই নমিনালিজমকে নিজের মূল দর্শন হিসেবে ব্যবহার করেছেন এবং মূলধারার ধর্মতাত্ত্বিক ধারাগুলোর বিরোধিতা করেছেন (যাতে হাম্বলি আলেমরাও ছিলেন)। অর্থাৎ ইবনে তায়মিয়্যাহর আলোচনাটা ছিল একজন দার্শনিকের জায়গা থেকে, যিনি গ্রিক দর্শনের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো নিয়ে চিন্তিত ছিলেন, ফলে জ্ঞানতত্ত্বে নতুন দর্শন হাজির করতে যিনি আগ্রহী ছিলেন। ইবনে তায়মিয়্যাহকে বুঝতে হলে, সবার আগে আপনাকে মাথায় ঢোকাতে হবে তিনি একজন দার্শনিক। দার্শনিকরা যখন কথা বলে, তখন সাধারণ মানুষ সেই কথা বুঝবে কিনা তা নিয়ে তিনি চিন্তিত থাকেন ন। তার একমাত্র চিন্তা হয়, যেন তার সমস্তরের যারা আছে তারা তার রিফিউটেশন ধরতে পারে। আর এই কারণেই বলা হয়, কেউ আশআরি আকিদা, ফখরুদ্দিন রাযির ইলমে কালাম ও ইবনে সিনার মানতিক না বোঝা পর্যন্ত ইবনে তায়মিয়্যাহকে বুঝতে পারবে না। শায়খ মিয়াও-এর সময় থেকে যেটা শুরু হয়, ইবনে তায়মিয়্যাহর এসব সেনসিটিভ আলাপকে বকলম মূর্খদের মুখস্থ করতে দিয়ে দেয়া হয়। ইবনে তায়মিয়্যাহর আরেকটা সমস্যা হল, তার সব চিন্তাভাবনা সলিড ও ফুলপ্রুফ ছিল না, যেমন তাওহিদের ত্রিত্ববাদ। ইবনে তায়মিয়্যাহ যে তাত্ত্বিক ট্রিনিটির প্রস্তাবক ছিলেন, সেটাকে শায়খ মিয়াও ঈমানের মৌলিক শর্ত সাব্যস্ত করেন। এই ট্রিনিটি ছিল নাজদি মিশনের কেন্দ্রিয় ডক্ট্রিন। আল্লাহর রুবুবিয়াত, আল্লাহর উলুহিয়ত এবং আল্লাহর আসমা ও সিফত। এছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ ছিল খারেজিদের ঈমান ও আমলকে বিভাজনের পুরোনো ডক্ট্রিন। নাজদি বাইবেলে একদম সাফসাফ লেখা আছে, গোটা উম্মত ঈমানের ক্ষেত্রে আশআরিদের যেই ব্যাখ্যা বিশ্বাস করে, সেটা নিরেট মুরজিয়া বিশ্বাস। এর পক্ষে তারা ইবনে তায়মিয়্যাহ থেকে কিছু কথাও দেখায়। কিন্তু ইবনে তায়মিয়্যাহ যে কাজটা কখনো করেন নি, সেটা তারা করে - ঈমান ও আমলের সেপারেশনের ভিত্তিতে তাকফির, অতঃপর সেই তাকফিরের ভিত্তিতে গণহত্যা।
(৭)
সালাফিদের বর্তমানে অসংখ্য উপ-ফেরকা আছে। কিন্তু প্রধান ধারা এদের কেবল তিনটি। এই তিন ফেরকার উদ্ভবের পেছনে ঐতিহাসিক কারণ আছে। যেহেতু নাজদি মিশন ছিল প্যাট্রিয়ার্ক মুহাম্মদ বিন আব্দুল ওয়াহহাব এবং বাদশাহ মুহাম্মদ বিন সউদের যৌথ প্রজেক্ট, তাই এখানে অ্যালিজিয়েন্স মূলত দুই জায়গায় - ক. শায়খ মিয়াও এর অথেন্টিক দাওয়াতকে মনেপ্রাণে ধারণ করার প্রত্যয়, খ. সৌদি রাজবংশের অথোরিটি অক্ষত রাখার অঙ্গীকার।
যারা প্রথমটি বেছে নেয়, তাদের আমরা বিশুদ্ধ নাজদি বলতে পারি। এই ধারার আইকনদের মধ্যে আছেন, সুলায়মান আল উলওয়ান, নাসির আল ফাহদ, আহমদ মুসা জিব্রিল, আসেম আল মাকদিসি। দুনিয়ার অন্য যেকোন দলের চেয়ে এরাই সৌদি পরিবারের সবচেয়ে বড় শত্রু, কারণ সৌদি পরিবারের ক্রেডিবিলিটি আসে যেই নাজদি দাওয়াত থেকে, সেই নাজদি ডক্ট্রিন থেকে যখন সৌদিদের আসমান-জমিন সমান বিচ্যুতি দেখানো হয়, তখন সৌদিদের এক বিন্দু পরিমাণ লেজিটিমেসি অবশিষ্ট থাকে না।
যারা দ্বিতীয় পথ বেছে নেয়, অর্থাৎ যেকোন মূল্যে আলে সৌদের অথোরিটি রক্ষা করতে হবে, তারাই পরবর্তীতে মাদখালি হিসেবে আবির্ভূত হয়, যদিও রবি আল মাদখালির বহু আগে থেকেই সৌদি রাজপরিবারকে নিঃশর্তভাবে সমর্থন দেয়ার চল নাজদিদের মাঝে ছিল। তাদেরকেও আমরা মাদখালি ধরতে পারি। অতীতে নাজদিদের মধ্যে বেশ কিছু গৃহযুদ্ধ ঘটেছিল। এই গৃহযুদ্ধগুলোই 'তাওহিদে হাকিমিয়া', 'কাফেরদের সহযোগিতা গ্রহণ', 'আল ওয়ালা ওয়াল বারা' কে ডিফাইন করার ব্যাপারে বিশুদ্ধ নাজদিদের থেকে মাদখালিদের পৃথক করে দেয়। অনেকেই ভাবতে পারেন, মাদখালিরা এই অল্টারনেট ব্যাখ্যা কোত্থেকে পেয়েছিল? এর উত্তর হচ্ছে, নাজদিরা যাকে নিজেদের আদিপিতা ও ডেমি-নবি ভাবে, সেই ইবনে তায়মিয়্যাহ ও তার ডিসাইপল ইবনুল কাইয়্যিমের কাছ থেকে। ইবনে তায়মিয়্যাহ ও ইবনুল কাইয়্যিমের লেখালিখিই মূলত মাদখালিদের মূল হাতিয়ার। এখান থেকেও বোঝা যায় যে, ইবনে তায়মিয়্যাহ সম্পর্কে নাজদিদের চিন্তাভাবনা আসলে ব্যাকপ্রজেকশন ছাড়া কিছু না। প্রত্যেক নাজদি ভাবে, সে যে মতামত বিশ্বাস করে, সেটাই তাদের ডেমি-নবি ইবনে তায়মিয়্যহর আনীত শিক্ষা ছিল।
তৃতীয় ধারার আলেমরা দুই কুলের মাঝে ব্যালেন্স করার চেষ্টা করেন। আত্মবিরোধিতা ও সাংঘর্ষিক কথাবার্তা বলার ক্ষেত্রে তাদের কোন জুরি নেই। ইবনে উসায়মিন, সালেহ আল ফাওযানরা হলেন এই ক্যাটাগরির আলেম। আর এরাই মুসলিম বিশ্বে নাজদিদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ। এরা তাত্ত্বিকভাবে প্রথম দল অর্থাৎ বিশুদ্ধ নাজদিদের অনুরূপ। কিন্তু প্রায়োগিকভাবে এরা মাদখালিদের মত। তাদের তাত্ত্বিক বয়ান ও প্রায়োগিক ব্যবহারের এই দ্বিচারিতা দেখেই, তরুণরা বিশুদ্ধ নাজদিদের দাওয়াতে জঙ্গি সন্ত্রাসী দলগুলোতে যোগ দেয়। তারপর যখন তারা খারেজি কর্মকাণ্ড চালায়, তখন এই তৃতীয় শ্রেণীর আলেমরা মাদখালিদের সাথে গলা মিলিয়ে তাদের সমালোচনা করে। অথচ এই তৃতীয় শ্রেণীর আলেমদের তাত্ত্বিক আলাপ ও প্রয়োগের বেলায় ভন্ডামিই এদেরকে ইন দ্যা ফার্স্ট প্লেস প্রথম শ্রেণীতে প্রবেশ করতে প্ররোচিত করেছিল।
উপমহাদেশে নজদি ইসলামের আমদানি এবং হালহাকিকত নিয়ে একটি প্রবন্ধ লেখার অনুরোধ রইল।