হজের তালবিয়া ও মুয়াবিয়ার চক্রান্ত
মাওলা আলীর প্রতি বিদ্বেষ থেকে আমিরে মুয়াবিয়ার লাব্বাইক ধ্বনি নিষিদ্ধকরণ
হজের মৌসুম চলছে। হাজিদের লাব্বাইক ধ্বণিতে পবিত্র নগরী মক্কা অনুরণিত হচ্ছে। শিরকের অন্ধকার থেকে মুক্ত হয়ে তাওহিদের ডাকে সাড়া দিতে হাজিরা বলছেন, "লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক"। ইহরাম থেকে পাথর নিক্ষেপ পর্যন্ত এই বাক্য পাঠ করাকে বলা হয় তালবিয়া। নবিয়ে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি সাল্লামের সময় থেকে চলে আসা তালবিয়ার এই সুন্নাত ও ঐতিহ্য আজও মুসলিমরা ধরে রেখেছে। কিন্তু অনেকেই হয়ত জানেন না, বনু উমাইয়া গোষ্ঠী নবির এই সুন্নাতকে চিরতরে মিটিয়ে দিতে চেয়েছিল।
মুসনাদে আহমদে হযরত সাঈদ বিন জুবাইর থেকে বর্ণিত আছে তিনি বলেন,
أَتَيْتُ عَلَى ابْنِ عَبَّاسٍ بِعَرَفَةَ وَهُوَ يَأْكُلُ رُمَّانًا، فَقَالَ:» أَفْطَرَ رَسُولُ اللهِ ﷺ بِعَرَفَةَ، وَبَعَثَتِ الَيْهِ أُمُّ الْفَضْلِ بِلَبَنٍ، فَشَرِبَهُ « وَقَالَ:» لَعَنَ اللهُ فُلانًا عَمَدُوا إِلَى أَعْظَمِ أَيَّامِ الْحَجِّ، فَمَحَوْا زِينَتَهُ، وَإِنَّمَا زِينَةُ الْحَجِّ التَّلْبِيَةُ
"আমি ইবনে আব্বাসের কাছে আরাফার দিন এলাম, তিনি ডালিম খাচ্ছিলেন। আল্লাহর রাসুল সা. আরাফার দিন ইফতার (খাদ্য গ্রহণ) করেন। আমাকে উম্মে ফাদ্বল তার কাছে দুধ দিয়ে পাঠান এবং তিনি সেটা পান করেন। তারপর বলেন, আল্লাহর লানত হোক "অমুক" এর ওপর। সে হজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনকে নিয়ে চক্রান্ত করে এর সৌন্দর্যকে মিটিয়ে দিয়েছে। হজের সৌন্দর্য তো তালবিয়া!"
শুয়াইব আরনাউত ও তার সহকর্মীরা মুসনাদে আহমদের টীকায় লিখেছেন, এটা সহিহ হাদিস, বর্ণনাকারী প্রত্যেকে বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য।
এই হাদিস থেকে আমরা জানলাম যে, জনৈক ব্যাক্তি হজের সৌন্দর্য "তালবিয়া"কে মিটিয়ে দেওয়ার চক্রান্ত করেছিল। এই হাদিসে সরাসরি তার নাম পাওয়া যায় না। মুসনাদে আহমদ ছাড়াও এটি মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাতে বর্ণিত হয়েছে। এই হাদিসটি সাঈদ বিন জুবাইর থেকে বর্ণনা করেছেন আইউব সুখতিয়ানি। তিনি সেই ব্যাক্তির নাম গোপন রেখে তার জায়গায় "অমুক" বলেছেন। চলুন আরো কিছু হাদিস দেখা যাক। তাহলে আমরা এই বিষয়ে আরো জানতে পারব।
সাঈদ বিন জুবাইর থেকে এই একই ঘটনা বর্ণনা করেছেন মিনহাল বিন আমর। মুসতাদরাকে হাকেমে তার হাদিসটি এসেছে নিচের শব্দে।
সাঈদ বিন জুবাইর থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
كنا مع ابن عباس بعرفة ، فقال لي : يا سعيد ما لي لا أسمع الناس يلبون ، فقلت : يخافون من معاوية ، قال : فخرج ابن عباس من فسطاطه ، فقال : لبيك اللهم لبيك ، فانهم قد تركوا السنة من بغض علي
"আমরা ইবনে আব্বাসের সাথে আরাফায় ছিলাম। তিনি আমাকে বললেন, হে সাঈদ! কী ব্যাপার আমি কেন লাব্বাইক ধ্বণি শুনছি না? আমি বললাম, মানুষ মুয়াবিয়াকে ভয় করে। সাঈদ বলেন, এটা শুনে ইবনে আব্বাস তার তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসেন এবং বলে ওঠেন, লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। এরা আলীর প্রতি বিদ্বেষ থেকে সুন্নাতকে পরিত্যাগ করেছে।"
হাকেম বলেন, হাদিসের সনদ সহিহ। ইবনে খুযায়মাও একে তার "সহীহ"তে স্থান দিয়েছেন। এছাড়াও এই হাদিসটি ইমাম নাসাই তার আস সুনানুল কুবরা ও আস সুনানুস সুগরাতে উল্লেখ করেছেন। শায়খ নাসিরুদ্দিন আলবানিও এই হাদিসকে "সহীহুল ইসনাদ" বলেছেন।
মিনহাল বিন আমর থেকে এই হাদিসটি ইমাম বায়হাকি তার "আস সুনানুল কুবরা"তে বর্ণনা করেছেন নিচের শব্দে যেখানে আরো কিছু তথ্য পাওয়া যায়।
সাঈদ বিন জুবাইর থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
كنا عند ابن عباس بعرفة ، فقال : يا سعيد ما لي لا أسمع الناس يلبون ، فقلت : يخافون معاوية فخرج ابن عباس من فسطاطه ، فقال : لبيك اللهم لبيك ، وإن رغم أنف معاوية اللهم العنهم فقد تركوا السنة من بغض علي
"আমরা ইবনে আব্বাসের সাথে আরাফাতে ছিলাম। তিনি বললেন, হে সাঈদ! আমি কেন মানুষের লাব্বাইক ধ্বণি শুনতে পাচ্ছি না? আমি বললাম, তারা মুয়াবিয়াকে ভয় পায়। এতে ইবনে আব্বাস তার তাঁবু থেকে বেরিয়ে আসেন এবং বলেন, লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক! মুয়াবিয়ার অপছন্দ হলেও আমি এটা বলব। আল্লাহ তোমার লানত হোক এদের ওপর। আলীর প্রতি বিদ্বেষ থেকে তারা সুন্নাতকে পরিত্যাগ করেছে।"
ইমাম ইবনে হাযম তালবিয়া নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লেখেন,
عَنْ عِكْرِمَةَ قَالَ: كُنْت مَعَ الْحُسَيْنِ بْنِ عَلِيٍّ فَلَبَّى حَتَّى رَمَى جَمْرَةَ الْعَقَبَةِ.
قَالَ أَبُو مُحَمَّدٍ: وَكَانَ مُعَاوِيَةُ يَنْهَى عَنْ ذَلِكَ.
"ইকরিমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হযরত হুসাইন বিন আলীর সাথে ছিলাম তিনি জামরাতুল আকাবায় পাথর নিক্ষেপ পর্যন্ত তালবিয়া দিচ্ছিলেন। আবু মুহাম্মদ (ইবনে হাযম) বলেন, মুয়াবিয়া তালবিয়া দিতে নিষেধ করতেন।"
নিছক মাওলা আলীর প্রতি বিদ্বেষ থেকে মুয়াবিয়া এমন আদেশ দিতেন। যা ইমাম তাহাবির এই হাদিসটা থেকে আরো স্পষ্টভাবে বোঝা যায়, যা তিনি তার আহকামুল কোরআন গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,
ইমাম তাহাবি বলেন,
قَدْ حَدَّثَنَا فَهْدُ بْنُ سُلَيْمَانَ، قَالَ: حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ عَبْدِ اللهِ بْنِ يُونُسَ، قَالَ: حَدَّثَنَا فُضَيْلٌ، عَنْ عُبَيْدٍ الْمُكْتِبُ، عَنْ سَعِيدٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، قَالَ: قَالَ يَوْمًا وَهُوَ بِعَرَفَةَ، وَذَكَرَ مُعَاوِيَةَ «أَمَا أَنَّهُ تَرَكَ التَّلْبِيَةَ فِي هَذَا الْيَوْمِ، لِأَنَّ عَلِيًّا كَانَ يُلَبِّي فِيهِ»
"আমাদের ফাহদ বিন সুলায়মান বলেছেন, তিনি বলেন আমাদের আহমদ বিন আব্দুল্লাহ বিন ইউনুস বলেছেন, আমাদের ফুদ্বাইল বলেছেন উবায়দ আল মুকতিব থেকে, তিনি সাঈদ (বিন জুবাইর) থেকে, তিনি ইবনে আব্বাস থেকে যে, ইবনে আব্বাস আরাফাতের দিন মুয়াবিয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, সে এই দিনে তালবিয়া পাঠ পরিত্যাগ করেছে কারণ আলী এই দিন তালবিয়া দিতেন।"
এছাড়াও মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বাহতে আছে,
أَبُو بَكْرٍ قَالَ: حَدَّثَنَا وَكِيعٌ، عَنِ الْأَعْمَشِ، عَنْ حَبِيبٍ، عَنْ سَعِيدِ بْنِ جُبَيْرٍ، عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ: ذُكِرَ لَهُ أَنَّ مُعَاوِيَةَ: نَهَى عَنِ التَّلْبِيَةِ، فَجَاءَ حَتَّى أَخَذَ بِعَمُودَيْ الْفُسْطَاطِ، ثُمَّ لَبَّى ثُمَّ قَالَ: «عَلِمَ أَنَّ عَلِيًّا كَانَ يُلَبِّي فِي هَذَا الْيَوْمِ، فَأَحَبَّ أَنْ يُخَالِفَهُ»
"আবু বকর (ইবনে আবি শায়বা) বলেন, আমাদের ওয়াকি বলেছেন, আমাদের আমাশ বলেছেন হাবিব থেকে, তিনি সাঈদ বিন জুবাইর থেকে, তিনি ইবনে আব্বাস থেকে বলেন যে, ইবনে আব্বাসের কাছে মুয়াবিয়ার আলাপ করা হল যে, তিনি তালবিয়া দিতে নিষেধ করেছেন। ফলে তিনি বেরিয়ে এসে তাঁবুর দুই খুঁটি ধরে তালবিয়া পাঠ করেন এবং বলেন, মুয়াবিয়া জানতে পেরেছে আলী এই দিনে তালবিয়া দিতেন, তাই সে এটা পরিত্যাগ করা পছন্দ করেছে।"
এখন প্রশ্ন হল, আলীর সাথে তালবিয়ার সম্পর্ক কী? এর উত্তর হচ্ছে, হযরত ওসমানের আমলের শেষ দিকে মানুষজনের মাঝ থেকে তালবিয়া দেওয়া হারিয়ে যাওয়া শুরু করে। হযরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদের একটি আসার থেকে আমরা এটা জানতে পারি। আসারটি ইমাম তাহাবি তার শারহু মাআনিল আসারে একাধিক সূত্রে বর্ণনা করেছেন। ইবনে সাখবারা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
غَدَوْتُ مَعَ ابْنِ مَسْعُودٍ غَدَاةَ جَمْعٍ، وَهُوَ يُلَبِّي فَقَالَ ابْنُ مَسْعُودٍ أَضَلَّ النَّاسُ أَمْ نَسُوا؟ أَشْهَدُ لَكُنَّا مَعَ رَسُولِ اللهِ ﷺ، فَلَبَّى حَتَّى رَمَى جَمْرَةَ الْعَقَبَةِ "
"আমি ইবনে মাসউদের সাথে একত্রিত হবার দিনের সকালে একসাথে ছিলাম। তিনি তালবিয়া দিচ্ছিলেন। তারপর ইবনে মাসউদ বললেন, মানুষ কি গোমরাহ হয়ে গেছে নাকি ভুলে গেছে? আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আমরা আল্লাহর রাসুলের সা. সাথে ছিলাম। তিনই জামরাতুল আকবা পর্যন্ত তালবিয়া দিতেন।"
হযরত আলী খিলাফত গ্রহণের পর এই ভুলে যাওয়া সুন্নাতকে পুনরোজ্জীবিত করেন। যেহেতু হযরত আলীর কারণে তালবিয়া আবার ফিরে আসে, তাই মুয়াবিয়া কেবল আলীর প্রতি বিরোধিতা থেকে তালবিয়া পড়ার সুন্নাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। ইবনে আব্বাস এই ব্যাপারেই বলেছেন যে, আলীর প্রতি বিদ্বেষ থেকে মুয়াবিয়া এটি করেছিলেন।