নাচ, গান, বাদ্য কখন হারাম?
নাচ, গান, বাদ্যযন্ত্র কোনটাই শর্তহীন ভাবে হারাম নয়। বরং পরিস্থিতি অনুযায়ী এর বিধান হয়ে থাকে।
আলোচনা শুরু করা যাক, ইমাম মালিকের একটি ঘটনা উল্লেখ করে। কাযী ইয়ায তারতিবুল মাদারিকে এবং ইবনে রুশদ আল মুদাওয়ানার ভূমিকায় নিচের ঘটনাটি উল্লেখ করেছেন।
قال المسيبي: كنا عند مالك وأصحابه حوله فقال رجل من أهل نصيبين يا أبا عبد الله عندنا قوم يقال لهم الصوفية يأكلون كثيرًا ثم يأخذون في القصائد ثم يقومون فيرقصون. فقال مالك: الصبيان هم؟ قال لا. قال أمجانين؟ قال لا، قوم مشائخ وغير ذلك عقلاء. قال مالك ما سمعت أن أحدًا من أهل الإسلام يفعل هذا. قال الرجل بل يأكلون ثم يقومون فيرقصون نوائب ويلطم بعضهم رأسه وبعضهم وجهه فضحك مالك ثم قام فدخل منزله. فقال أصحاب مالك للرجل لقد كنت يا هذا مشؤومًا على صاحبنا، لقد جالسناه نيفًا وثلاثين سنة فما رأيناه ضحك إلا في هذا اليوم.
মুসিবি বলেন, আমরা ইমাম মালিকের সঙ্গে ছিলাম। তার সঙ্গীরা তার চারপাশে ছিলেন। নাসিবাইন অঞ্চল থেকে আগত এক লোক তাকে প্রশ্ন করল, হে আবু আব্দিল্লাহ! আমাদের এখানে একদল মানুষ আছে যারা সুফি নামে পরিচিত। তারা অনেক খাওয়া-দাওয়া করে, তারপর কবিতা আবৃত্তি করে, তারপর দাঁড়িয়ে নাচে। মালিক জিজ্ঞেস করলেন, তারা কি শিশু? লোকটি উত্তর দেয়, না। মালিক প্রশ্ন করেন, তবে কি পাগল? সে বলল, না। তারা বয়স্ক, এছাড়াও তাদের মাথা ঠিক আছে। ইমাম মালিক, ইসলামের অনুসারী কেউ, এমন কিছু করে তা আমি আগে শুনি নি। লোকটি ফের বলল, তারা খায়-দায়, তারপর দাঁড়িয়ে পালাবদল করে নাচানাচি করে, কেউ তার মাথা চাপড়ায়, কেউ তার গাল চাপড়ায়। ইমাম মালিক এটা শুনে হেসে ওঠেন এবং বাড়ি চলে যান। এতে মালিকের সঙ্গীরা লোকটিকে বলে, এই মিয়া! আমাদের সঙ্গীকে তো তুমি বিপদে ফেলে দিয়েছ। আমরা ত্রিশেরও অধিক বছর তার সঙ্গে একসাথে মজলিসে বসেছি, কিন্তু আজকের আগে কোনদিন তাকে হাসতে দেখি নি।
সুত্র: তারতিবুল মাদারিক, ১/৯৪।
বেশ মজার ঘটনা, তাই না! বয়স্ক মানুষ নাচানাচি করে, এটা ইমাম মালিকের কাছে পাগলামি ছাড়া কিছু ঠেকে নি। এমন বিচিত্র কাজ আন্দালুস থেকে সমরকন্দ পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে মুসলিমরা সুস্থ মস্তিষ্কে করে থাকে, এটাও তার কাছে অদ্ভুত ঠেকেছে। মানুষ হাত-পা দুলিয়ে নাচছে, এমন সঙসুলভ কাজ কেউ গম্ভীর চেহারায় মানুষ করে বেড়াচ্ছে, চিন্তা করতেই তিনি হাসিতে ফেটে পড়েন। হাসি থামাতে না পেরে বাড়ি চলে যান!
এই ঘটনাটাতে থেকে আমরা একটা বিষয় বুঝতে পারি, ইমাম মালিক যেই সামাজিক আবহাওয়া ও পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন, সেখানে পুরুষ মানুষ বিনোদনের জন্য নাচতে পারে এটা তার জন্য অকল্পনীয় ছিল। ইসলামি শরিয়তে মুরুয়াতের ধারণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মুরুয়াত শব্দটি আরবি মার (مرء) থেকে এসেছে। মার অর্থ ব্যাক্তি। মুরুয়াত হল ব্যাক্তিত্বশীলতা বা রুচিশীলতা।
ইমাম নববি মিনহাজুত তালেবিন গ্রন্থে বলেন,
ويحرم اللعب بالنرد على الصحيح ويكره بشطرنج فإن شرط فيه مال من الجانبين فقمار ويباح الحداء وسماعه ويكره الغناء بلا آلة وسماعه ويحرم استعمال آلة من شعار الشربة كطنبور وعود وصنج ومزمار عراقي وإسماعها لا يراع في الأصح . قلت: الأصح تحريمه والله أعلم ويجوز دف لعرس وختان وكذا غيرهما في الأصح وإن كان فيه جلاجل ويحرم ضرب الكوبة وهي طبل طويل ضيق الوسط لا الرقص إلا أن يكون فيه تكسر كفعل المخنث ويباح قول شعر وإنشاده إلا أن يهجو أو يفحش أو يعرض بامرأة معينة والمروءة تخلق بخلق أمثاله في زمانه ومكانه فالأكل في سوق والمشي مكشوف الرأس وقبلة زوجة وأمة بحضرة الناس وإكثار حكايات مضحكة ولبس فقيه قباء وقلنسوة حيث لا يعتاد وإكباب على لعب الشطرنج أو غناء أو سماعه وإدامة رقص يسقطها والأمر فيه يختلف بالأشخاص والأحوال والأماكن
পাশা খেলা হারাম, তবে দাবা খেলা অপছন্দনীয়(*)। যদি দুই পক্ষ থেকে বাজি ধরা হয়, তাহলে এটি জুয়া গণ্য হবে। হুদা (উট চালানোর গান) গাওয়া ও শোনা বৈধ। তবে এমনিতে বাদ্যযন্ত্র ব্যাতিরেকে গান গাওয়া ও শোনা অপছন্দনীয়। মদ্যপায়ীদের প্রতীক হিসেবে যেগুলো ব্যবহৃত হয় যেমন তম্বুরা, উদ, করতাল, ইরাকি সানাই তা ব্যবহার হারাম। তবে বাঁশি নয়। আমার মতে, শুদ্ধতর মত অনুযায়ী বাঁশিও হারাম। আল্লাহ ভালো জানেন। তবে বিয়ে, খতনা কিংবা অন্যান্য আয়োজনে দুফ বাজানো বৈধ, যদিও তাতে ঝুনঝুনি থাকে। এছাড়াও কুবা, যা হচ্ছে লম্বা ও মাঝে চিকন তবলা বাজানো হারাম। নাচা হারাম নয়। তবে যদি এতে হিজড়াদের মত অঙ্গভঙ্গি থাকতে পারবে না। কবিতা পড়া ও আবৃত্তি করা বৈধ, তবে নিন্দা করা, অশ্লীল কথা বলা কিংবা কোন নির্দিষ্ট নারীর বিবরণ দেয়া যাবে না। মুরুয়াত বা ব্যক্তিত্বশীলতা হচ্ছে নিজ যুগের, নিজ সমাজের, সমশ্রেণীর মানুষের অনুরূপ আচার-ব্যবহার করা। রাস্তায় খাওয়া, খোলা মাথায় হাঁটা, জনসম্মখে স্ত্রী কিংবা দাসীকে চুমু খাওয়া, বেশি বেশি রসিকতা করা, প্রচলনহীন অঞ্চলে আলেমের জন্য টুপি ও জুব্বা পরা, দাবা খেলা কিংবা গান গাওয়া বা শোনা নিয়ে পড়ে থাকা, সদাসর্বদা নাচা এসব বিষয় মুরুয়াত বা ব্যাক্তিত্বের স্খলন ঘটায়। তবে এই বিষয়গুলো স্থান, কাল ও পাত্রভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।
সুত্র: মিনহাজুত তালেবীন, পৃষ্ঠা ৩৪৫।
(*) ইমাম শাফেয়ী তার উম্ম কিতাবে দাবা খেলার ব্যাপারে বলেছেন, আমি এটা পছন্দ করি না। ইমাম বুলকিনি তার তাদরিব গ্রন্থে লিখেছেন,
وفي قول: يكرَهُ، والأولى أن لا يعلبَ بالشطرنجِ؛ لأنّ الشافعيَّ قال: إنه لا يحبُّ اللعبَ به. قال شيخُنا: والذي لا يحبُّه قد يكونُ خلافَ الأولى، وقد يكونُ المرادُ لا أحبُّ أنْ أفعلَهُ لما يؤدِّي إليهِ؛ لا أنّهُ مكروهٌ في نفسِهِ، لكنْ إن أدّى اللعبُ بِهِ إلى شغلِ المكلَّفِ بحيثُ تخرجُ الصلاةُ عن وقتِها وهو غافلٌ حرمُ اللعبُ به حينئذٍ.
এক মত অনুযায়ী, দাবা অপছন্দনীয় এবং সর্বোত্তম হল না খেলা। কেননা ইমাম শাফেয়ী বলেছেন, আমি এর মাধ্যমে খেলা পছন্দ করি না। আর তিনি যা পছন্দ করেন না, তার মাধ্যমে কখনো সর্বোত্তমের বিপরীত বোঝানোও হয়ে থাকে। এছাড়াও এর অর্থ হতে পারে যে, আমি এটা করতে পছন্দ করি না কারণ এটা অন্যান্য মন্দ বিষয়ের দিকে ধাবিত করে; খোদ দাবা অপছন্দনীয় হবার কারণে নয়। বরং এই কারণে যে, দাবা খেলা মানুষকে তার দায়িত্ব ভুলিয়ে দেয়, দাবায় ডুবে থেকে অবহেলা বশত নামাযের ওয়াক্ত ফুরিয়ে যায়। এমতবস্থায় দাবা খেলা হারাম হবে।
সুত্র: আত তাদরিব ফিল ফিকহিশ শাফেয়ী, ৪/৩৬৪।
মিনহাজুত তালেবীনে ইমাম নববির ওপরের আলোচনায় আমরা দেখলাম যে, তিনি শাফেয়ী মাযহাবের অবস্থান উল্লেখ করে বলছেন যে, নাচা হারাম নয়। কিন্তু হিজড়াদের অনুকরণ করা হলে হারাম হবে। আর বাদ্যযন্ত্রের ক্ষেত্রে তিনি বলেছেন, কেবল সেসবই হারাম যা কিনা সমাজে মদ্যপ চেনার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ বাদ্যযন্ত্র মৌলিকভাবে হারাম নয়। বরং পাপিষ্ঠ ও অনাচারীদের সাথে বৈপরীত্য প্রদর্শন করার জন্য তাদের চিহ্নে পরিণত হওয়া যন্ত্র থেকে শাফেয়ী মাযহাবে নিষেধাজ্ঞা এসেছে। এই বিষয়ে ইমাম গাযালী ইহইয়াউল উলুমে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। আমাদের আলোচ্য বিষয়ের খাতিরে কেবল এই মুল্যবান আলোচনার একাংশ উল্লেখ করছি।
ইমাম গাযালি বলেন,
الاجتماع عليها لما أن صار من عادة أهل الفسق فيمنع من التشبه بهم لأن من تشبه بقوم فهو منهم وبهذه العلة نقول بترك السنة مهما صارت شعارًا لأهل البدعة خوفًا من التشبه بهم وبهذه العلة يحرم ضرب الكوبة وهو طبل مستطيل دقيق الوسط واسع الطرفين وضربها عادة المخنثين ولولا ما فيه من التشبه لكان مثل طبل الحجيج والغزو وبهذه العلة نقول لو اجتمع جماعة وزينوا مجلسًا وأحضروا آلات الشرب وأقداحه وصبوا فيها السكنجبين ونصبوا ساقيًا يدورعليهم ويسقيهم فيأخذون من الساقي ويشربون ويحيي بعضهم بعضًا بكلماتهم المعتادة بينهم حرم ذلك عليهم وإن كان المشروب مباحًا في نفسه لأن في هذا تشبهًا بأهل الفساد بل لهذا ينهى عن لبس القباء وعن ترك الشعر على الرأس قزعًا في بلاد صار القباء فيها من لباس أهل الفساد ولا ينهى عن ذلك فيما وراء النهر لاعتياد أهل الصلاح ذلك فيهمف بهذه المعاني حرم المزمار العراقي والأوتار كلها كالعود والصنج والرباب والبربط وغيرها وما عدا ذلك فليس في معناها كشاهين الرعاة والحجيج وشاهين الطبالين وكالطبل والقضيب وكل آلة يستخرج منها صوت مستطاب موزون سوى ما يعتاده أهل الشرب لأن كل ذلك لا يتعلق بالخمر ولا يذكر بها ولا يشوق إليها ولا يوجب التشبه بأربابها فلم يكن في معناها فبقي على أصل الإباحة قياسًا على أصوات الطيور وغيرها بل أقول سماع الأوتار ممن يضربها على غير وزن متناسب مستلذ حرام أيضًا وبهذا يتبين أنه ليست العلة في تحريمها مجرد اللذة الطيبة بل القياس تحليل الطيبات كلها إلا ما في تحليله فساد قال الله تعالى ﴿قل من حرم زينة الله التي أخرج لعباده والطيبات من الرزق﴾ فهذه الأصوات لا تحرم من حيث إنها أصوات موزونة وإنما تحرم بعارض آخر
গানবাদ্যের জন্য একত্রিত হওয়া যেহেতু পাপাচারীদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, তাই তাদের সাদৃশ্য গ্রহণ ত্যাগ করতে, এটা থেকে বিরত থাকতে হবে। কারণ মানুষ যাদের সাদৃশ্য গ্রহণ করে, তাদের অন্তর্ভূক্ত বলেই বিবেচিত হয়। আর এই যুক্তিতেই আমরা বলি যে, যখন কোন সুন্নাত, বিদআতিদের প্রতীকে পরিণত হবে, তখন তাদের সাথে সাদৃশ্য হবার আশঙ্কা থেকে এই সুন্নাত পরিত্যাগ করতে হবে। আর এই একই যুক্তিতে, কুবা - লম্বা তবলা যার দুই প্রান্ত প্রশস্ত ও মাঝামাঝি চিকন - বাজানো হারাম হবে যেহেতু এটা হিজড়াদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। যদি এই সাদৃশ্য না থাকত, তবে একে হজ কিংবা যুদ্ধে ব্যবহৃত ঢাকের অনুরূপ বিবেচনা করা হত। একই যুক্তিতে আমরা বলি, যদি একদল মানুষ একত্রিত হয়ে সুন্দর করে আসর সাজিয়ে, মদ্যপানের সরঞ্জাম হাজির করে, পেয়ালাতে সেকানজাবিন ঢালে, একজন সাকি নিযুক্ত করে যে ঘুরে ঘুরে সবাইকে ঢেলে ঢেলে দেয়, মানুষ তার কাছ থেকে নিয়ে পান করে, মদ্যপ লোকদের অভ্যাস অনুযায়ী কথাবার্তা বলে একে অন্যকে জাগিয়ে রাখে, তবে এই সবই তাদের জন্য হারাম হবে। সেকানজাবিন হারাম পানীয় হবার কারণে নয়, বরং দুর্বৃত্তদের সাদৃশ্য গ্রহণের কারণে। আর এই কারণেই জুব্বা পরা ও মাথার চুল আংশিক মুণ্ডন করতে নিষেধ করা হয় এমন অঞ্চলে যেখানে এগুলো অনাচারীদের বেশভুষায় পরিণত হয়েছে, কিন্তু মাওরাউন্নহর অঞ্চলে এটা করতে নিষেধ করা হবে না কারণ সেখানে ভালো মানুষেরা এই পোশাক পরে থাকে। সুতরাং এখান থেকে বোঝা গেল কেন ইরাকি সানাই, সকল তারের যন্ত্র, উদ, করতাল, রাবাত, বারবাত এসব হারাম হয়েছে। কিন্তু এই অর্থের মাঝে শামিল নয়, এমন যেসকল যন্ত্র আছে, যেমন: রাখাল কিংবা হাজিদের শাহীন (সানাই সদৃশ যন্ত্র), তবলাবাদকদের শাহীন, তবলা কিংবা বাঁশি সহ যত যন্ত্র, যা থেকে সুন্দর ও ছন্দপূর্ণ শব্দ বের হয় এবং তা মদ্যপায়ীদের অভ্যাসে পরিণত হয় নি, মদের সাথে এর কোন সংযোগ নেই, যেগুলো মদের কথা মনে করিয়েও দেয় না, মদের প্রতি আকৃষ্টও করে না, মদ্যপ লোকদের সাথে সাদৃশ্যও তৈরি করে না, তবে হারাম হবার যেই অর্থ রয়েছে, তাতে এসব অন্তর্ভূক্ত হবে না এবং এর হুকুম আদি অবস্থার উপর অবশিষ্ট থেকে যাবে, আর সেটা হচ্ছে বৈধতা, যেমনটি পাখির মিষ্টি ধ্বনি ইত্যাদির সাথে তুলনা করে আমরা বলতে পারি। অথচ তারের যত যন্ত্র আছে সেগুলো যদি সঠিক ও স্বাদপূর্ণ সুর ছাড়াও বাজানো হয়, তবে তাও আমার মতে হারাম। আর এর মাধ্যমে এটাও স্পষ্ট হচ্ছে যে, গানবাদ্য হারাম হবার কারণ এর সৌন্দর্য ও মধুরতা নয়। বরং কিয়াসের দাবি হচ্ছে, সকল সুন্দর জিনিস হালাল হবে, যতক্ষণ সেটা হালাল সাব্যস্ত করা ফাসাদের কারণ না হচ্ছে। আল্লাহ বলেছেন, “বল, কে হারাম করল আল্লাহর তৈরি এই সৌন্দর্যগুলো যা তিনি তার বান্দাদের জন্য পবিত্র রিযিক হিসেবে নির্গত করেছেন?” এই আওয়াজগুলো তাদের ছন্দপূর্ণতার কারণে হারাম হয় নি, বরং বাহ্যিক বিভিন্ন কারণে হয়েছে।
সুত্র: ইহইয়াউ উলুমিদ দীন, ২/২৭২-৩।
তো আমরা নাচের আলোচনায় ফিরে আসি, ইমাম নববির বক্তব্যের ব্যাখ্যা করে ইমাম রমলি বলেন,
لا الرَّقْصُ فَلا يَحْرُمُ ولا يُكْرَهُ لِأنَّهُ مُجَرَّدُ حَرَكاتٍ عَلى اسْتِقامَةٍ واعْوِجاجٍ ولِإقْرارِهِ - ﷺ - الحَبَشَةَ عَلَيْهِ فِي مَسْجِدِهِ يَوْمَ عِيدٍ، نَعَمْ لَوْ كَثُرَ الرَّقْصُ بِحَيْثُ أسْقَطَ المُرُوءَةَ حَرُمَ عَلى ما قالَهُ البُلْقِينِيُّ، والأوْجَهُ خِلافُهُ (إلّا أنْ يَكُونَ فِيهِ تَكَسُّرٌ كَفِعْلِ المُخَنَّثِ) بِكَسْرِ النُّونِ وهَذا أشْهَرُ وفَتْحِها وهُوَ أفْصَحُ، فَيَحْرُمُ عَلى الرِّجالِ والنِّساءِ، وهُوَ مَن يَتَخَلَّقُ بِخُلُقِ النِّساءِ حَرَكَةً وهَيْئَةً، وعَلَيْهِ حَمْلُ الأحادِيثِ بِلَعْنِهِ، أمّا مَن يَفْعَلُ ذَلِكَ خِلْقَةً مِن غَيْرِ تَكَلُّفٍ فَلا يَأْثَمُ بِهِ.
নাচা হারাম নয়, মাকরুহও নয়। এটা কেবল নড়াচড়ার নাম, কখনো সোজা হয়ে, কখনো বাঁকা হয়ে। এছাড়াও নবিজি হাবশিদের ঈদের দিন মসজিদে এর অনুমতি দিয়েছিলেন। তবে হ্যাঁ, যদি এত বেশি নাচানাচি করে যে, এর কারণে তার মুরুয়াত বা ব্যাক্তিত্বের স্খলন ঘটে, তবে এটা বুলকিনির মত অনুযায়ী হারাম হবে। তবে অধিকতর যৌক্তিক মত হচ্ছে, হারাম হবে না (কেবল মাকরুহ হবে)। তবে যদি নাচের মাঝে হিজড়াদের অনুরূপ অঙ্গভঙ্গি থাকে, তবে নারী-পুরুষ উভয়ের জন্যই এটা হারাম হবে। অর্থাৎ পুরুষ এমন আচরণ, চলাফেরা কিংবা আকৃতি গ্রহণ করবে যা নারীদের সদৃশ হবে। হাদিসে যে লানতের কথা আছে, তা এদের ওপরই প্রযোজ্য। কিন্তু এই অতিরঞ্জন ত্যাগ করে সহজ-স্বাভাবিকভাবে যদি করা হয়, তবে এতে গুনাহ হবে না।
সুত্র: নিহায়াতুল মুহতাজ, ৮/২৯৮।
ইমাম রমলি এখানে রাসুলের ঐ হাদিসের কথা উল্লেখ করেছেন যেখানে رقص (রকস) زفن (যাফন) শব্দ আছে যার অর্থ নাচা। রকস শব্দটি এসেছে হযরত আনাস থেকে বর্ণিত মুসনাদে আহমদের হাদিসে। যার সনদ সহিহ। আর আয়েশার হাদিস যাতে যাফন শব্দ এসেছে, তা তিরমিযিতে একক সুত্রে (গরিব) এসেছে। সনদের দিক থেকে তা হাসান। এছাড়াও একই ঘটনা মুসলিমে আবু হুরায়রার সুত্রে এসেছে, কিন্তু তিনি একে لعب (লাইব) বা খেলা হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
এছাড়াও ইমাম বায়হাকি তার বিখ্যাত হাদিসগ্রন্থ আস সুনানুল কুবরা’তে বলেন,
بابُ: مَن رَخَّصَ فِي الرَّقْصِ إذا لَمْ يَكُنْ فِيهِ تَكَسُّرٌ وتَخَنُّثٌ
٢١٠٢٧ - أخْبَرَنا أبُو الحُسَيْنِ مُحَمَّدُ بْنُ عَلِيِّ بْنِ خُشَيْشٍ المُقْرِئُ بِالكُوفَةِ، أنبأ أبُو جَعْفَرٍ مُحَمَّدُ بْنُ عَلِيِّ بْنِ دُحَيْمٍ الشَّيْبانِيُّ، ثنا أحْمَدُ بْنُ حازِمِ بْنِ أبِي غَرَزَةَ، ثنا عُبَيْدُ اللهِ بْنُ مُوسى، عَنْ إسْرائِيلَ، عَنْ أبِي إسْحاقَ، عَنْ هانِئِ بْنِ هانِئٍ، عَنْ عَلِيٍّ، قالَ: أتَيْنا رَسُولَ اللهِ ﷺ أنا وجَعْفَرٌ وزَيْدٌ، فَقالَ لِزَيْدٍ: «أنْتَ أخُونا ومَوْلانا»، فَحَجَلَ، وقالَ لِجَعْفَرٍ: «أشْبَهْتَ خَلْقِي وخُلُقِي»، فَحَجَلَ وراءَ حَجْلِ زَيْدٍ، ثُمَّ قالَ لِي: «أنْتَ مِنِّي وأنا مِنكَ»، فَحَجَلْتُ وراءَ حَجْلِ جَعْفَرٍ قالَ الشَّيْخُ: "هانِئُ بْنُ هانِئٍ لَيْسَ بِالمَعْرُوفِ جِدًّا، وفِي هَذا - إنْ صَحَّ - دَلالَةٌ عَلى جَوازِ الحَجْلِ، وهُوَ أنْ يَرْفَعَ رِجْلًا، ويَقْفِزَ عَلى الأُخْرى مِنَ الفَرَحِ، فالرَّقْصُ الَّذِي يَكُونُ عَلى مِثالِهِ يَكُونُ مِثْلَهُ فِي الجَوازِ، واللهُ أعْلَمُ
পরিচ্ছেদ: অঙ্গভঙ্গি ও হিজড়াসুলভ আচরণ ব্যাতিরেকে নাচের ব্যাপারে ছাড় প্রদান যারা করেছেন
২১০২৭ - আমাদের আবুল হুসাইন মুহাম্মদ বিন আলী বিন খুশায়শ আল মুকরি কুফাতে বলেছেন, আমাদের … হানি বিন হানি থেকে বর্ণনা করেছেন আলী থেকে, যে তিনি বলেছেন, আমি, জাফর ও যায়দ আল্লাহর রাসুলের কাছে আসলাম। রাসুল যায়দকে বললেন, তুমি আমাদের ভাই ও মাওলা। এ শুনে যায়দ হাজল শুরু করে। তারপর তিনি জাফরকে বলেন, আমার আকৃতি ও স্বভাবের সাথে তোমার মিল আছে। এটা শুনে জাফরও যায়দের পেছনে হাজল শুরু করে। তারপর তিনি আমাকে বলেন, তুমি আমার, আমি তোমার। আমি এটা শুনে জাফর পেছনে হাজলে যোগ দেই।
বায়হাকি বলেন, হানি বিন হানি খুব বেশি বিখ্যাত নন। যদি এই বর্ণনা সহিহ হয়, তবে এর মাধ্যমে হাজল করার বৈধতা জানা যায়। হাজল হচ্ছে আনন্দের কারণে এক পা তুলে, অন্য পা দিয়ে লাফিয়ে বেড়ানো। সুতরাং যেই নাচ এর অনুরূপ হবে, বৈধতার ক্ষেত্রেও তা হাজলের অনুরূপ হবে। আল্লাহ ভালো জানেন।
সুত্র: আস সুনানুল কুবরা, ১০/৩৮২।
এই হাদিস মূলত আহলে বায়তের মধ্যকার একটা ঘটনার প্রেক্ষাপটে এসেছে। নবির চাচা হামযা উহুদে শহীদ হবার পর তার ছোট মেয়ের থাকার কোন ঠিকানা ছিল না। তাই তার দায়িত্ব কে নিবে এই নিয়ে নবী পরিবারের তিন সদস্য আলী, জাফর ও যায়েদের মধ্যে বিতর্ক হয়। ঘটনার পূর্ণ বিবরণ আমরা আহলে বায়তের দুই শ্রেষ্ঠ ব্যাক্তি ইমাম জাফর সাদেক এবং ইমাম মুহাম্মদ বাকের থেকে জানতে পারি।
ইবনে সা’দ তার তাবাকাত গ্রন্থে বলেন,
قال: أخبرنا الفضل بن دكين، قال: حدثنا حفص بن غياث، عن جعفر بن محمد، عن أبيه، قال: إن ابنة حمزة لتطوف بين الرجال, إذ أخذ عليٌّ بيدها، فألقاها إلى فاطمة في هودجها، قال: فاختصم فيها علي, وجعفر, وزيد بن حارثة, حتى ارتفعت أصواتهم، فأيقظوا النبي صلى الله عليه وسلم من نومه, قال: «هلموا أقض بينكم فيها وفي غيرها»، فقال علي: ابنة عمي، وأنا أخرجتها وأنا أحق بها، وقال جعفر: ابنة عمي, وخالتها عندي، وقال زيد: ابنة أخي، فقال في كل واحد قولًا رضيه، فقضى بها لجعفر، وقال: الخالة والدة، فقال جعفر: فحَجِل حول النبي صلى الله عليه وسلم، دار عليه، فقال النبي صلى الله عليه وسلم: «مَا هَذَا؟»، قال: شيء رأيت الحبشة يصنعونه بملوكهم.
আমাদের ফাদল বিন দুকাইন বলেছেন, আমাদের হাফর বিন গিয়াস বলেছেন, মুহাম্মদ বাকের থেকে জাফর সাদেকের সুত্রে যে, তিনি বলেন,
“হামযার মেয়ে থাকার জন্য বিভিন্ন মানুষের ঘরে পালাবদল হচ্ছিল। এমন সময় আলী তার হাত ধরে তাকে ফাতিমার ঘরে ঢুকিয়ে দেন। এর কারণে আলী, জাফর এবং যায়দ বিতর্কে লিপ্ত হন। তাদের গলার আওয়াজ বেড়ে যায়, ফলে নবীর ঘুম ভেঙে যায়। তিনি তাদের বলেন, আমার কাছে এসো। আমি সমাধান করে দেই। আলী বললেন, “সে আমার চাচাতো বোন। আমি তাকে বের করে এনেছি, আমার দাবিই বেশি।” জাফর বললেন, “সে আমারো চাচাতো বোন, আর তার খালা আমার কাছে আছে।” যায়দ বললেন, “সে আমার ভাইয়ের বোন।” নবি তাদের তিনজনের প্রত্যেককেই এমন কথা বললেন, যাতে তারা আনন্দিত হল। আর তিনি জাফরের পক্ষে রায় দিলেন এবং বললেন, “খালা মায়ের সমান।” এতে জাফর নবির চারপাশে ঘুরে ঘুরে হাজল নৃত্য শুরু করেন। নবি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “এটা কী করছ?” তিনি বললেন, আমি এটা হাবশায় দেখেছি, “তারা তাদের রাজাদের চারপাশে এটা করে।”
সুত্র: আত তাবাকাতুল কুবরা, ৪/৩২।
বিঃদ্রঃ নবির পবিত্র পরিবারের ব্যাপারে তার দুই বংশধর ইমাম জাফর সাদেক ও ইমাম বাকের থেকে বর্ণিত এই ঘটনাকে কোন কোন বনু উমাইয়া-ভক্ত মুরসাল বলে দূর্বল সাব্যস্ত করার চেষ্টা করে। তারা বলে, আলীর নাতি ইমাম যয়নুল আবেদিনের পুত্র ইমাম বাকের কীভাবে এই ঘটনা জানলেন, তিনি তো এটা দেখেন নি! তারা এই বলে এই বর্ণনাকে মুরসাল ও দূর্বল আখ্যা দেয়ার চেষ্টা করে। আল্লাহ তাদের বিচার করুক। নবির পরিবারের একটা ঘটনা নিয়ে নবির পরিবারের দুই নক্ষত্র না জেনে বানিয়ে বানিয়ে বলবেন কিংবা নবির পরিবারের বাইরের মানুষের কাছ থেকে শুনে বলবেন? সাহাবিরা নবি থেকে কিছু বর্ণনা করলে যেমন আমরা খোঁজ করি না যে, তিনি কার কাছে এটা শুনেছেন, তেমনি নবির পরিবার সম্পর্কে তার পরিবারের কেউ কিছু বললেও সেটা নিয়ে খোঁজ করাও নিরর্থক একটি কাজ।
ওপরের আলোচনায় আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, গানবাদ্য হোক, নাচ হোক কিংবা দাবা হোক, সবক্ষেত্রে স্থান-কাল-পাত্রকে বিবেচনায় রাখতে হবে। এমন যেকোন কাজ পরিহার করতে হবে যাতে পাপাচারীদের অনুকরণের স্পষ্ট ছাপ পাওয়া যায়। যে সমাজে নাচের কোন চল নেই, নাচাকে পাগল কিংবা শিশুদের কাজ হিসেবে দেখা হয়, যেমন ইমাম মালিক বলেছেন, তেমন সমাজে নাচ বিষয়টি ব্যাক্তিত্বহীনতার পরিচয় হয়। আর মুরুয়াতের খেলাফ যেকোন কাজই মাকরুহ। যেমন ইমাম নববির মিনহজ গ্রন্থের আরেক ব্যাখ্যাগ্রন্থ তুহফাতুল মুহতাজে ইবনে হাজার আল হায়তামি বলেন,
قالَ ابْنُ عَبْدِ السَّلامِ: الرَّقْصُ لا يَتَعاطاهُ إلّا ناقِصُ العَقْلِ ولا يَصْلُحُ إلّا لِلنِّساءِ.
ইযযুদ্দিন বিন আব্দিস সালাম বলেন, বুদ্ধিতে ত্রুটিযুক্ত না হলে, কোন পুরুষ নাচে না। নাচ কেবল নারীদের জন্যই শোভনীয়।
সুত্র: তুহফাতুল মুহতাজ, ১০/২২১।
আর সাথে যদি পাপাচারে লিপ্ত মানুষজনের অনুকরণ যুক্ত হয়, তবে তা এই সাদৃশ্য গ্রহণের বিষয়টির বিবেচনায় হারামের পর্যায়ে চলে যাবে। কিন্তু যদি এগুলো না থাকে, আওরাত বা গোপনীয় অঙ্গের উন্মোচন না হয়, তবে নারী কিংবা পুরুষ সবার জন্যই নাচার বৈধতা আছে। কিন্তু পুরুষ অডিয়েন্সের সামনে নারীর শরীর হেলানো-দোলানো যেহেতু তাদের কামলিপ্সা জাগ্রহ করবে, তাই এটা পরিহার করতে হবে। হ্যাঁ, যদি পারিবারিক ও ঘরোয়া পরিবেশে এবং পরিচিত মানুষজনের সামনে, অতিরিক্ত নড়াচড়ার মাধ্যমে শরীর প্রদর্শন পরিত্যাগ করে, শালীনতা বজায় রেখে ধীরেসুস্থে নাচা হয়, যেখানে এই অনাকাঙ্ক্ষিত এই বিষয়গুলো উপস্থিত নেই, তবে এটা শরিয়ত বিরোধী হবে না ইনশাআল্লাহ।
আল্লাহই সর্বাধিক জ্ঞাত আছেন।
নাচা বলতে আরবরা কি বুঝতো? নাচা শব্দর্টার জন্য আরবীতে কি কি শব্দ আছে জানতে চাই
বিশ্লেষণ পূর্ণ সুন্দর লেখনীর জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি ❤️