মা. আব্দুল মালেক এবং তার আল কাওসার পত্রিকা নিয়ে কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি পারতপক্ষে কথা বলতে চাই না। কারণ জনাব আব্দুল মালেককে নিয়ে এক ধরণের হলুদ রাজনীতি করা হয়। তিনি তাকি উসমানির ছাত্র, মুহাম্মাদ আওয়ামা ও আবু গুদ্দার ছাত্র। এসব বলে তার ব্যাপারে একটা মোহ সৃষ্টি করা হয়। তার এবং তার সাথে যুক্ত যেকোন সক্রিয়তাকে বৈধতা ও স্বীকৃতি দেয়া হয়, এমনকি চূড়ান্ত সত্য বলে মানুষের সামনে উপস্থাপন করা হয়। আল কাওসার পত্রিকা এমনই এক বিষয়। এই পত্রিকাটি আব্দুল মালেকের নাম বিক্রি করে কত যে হলুদ কর্মকাণ্ড আঞ্জাম দিয়েছে, তার ইয়ত্তা নেই। তাদের কোন কাজ দেখলেই, সবার আগে তাদের ইলমি খিয়ানত মনকে পীড়া দেয়। আবার এই বিষয়গুলো মানুষকে বললে, তারা একে কওমি বিদ্বেষ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করে। আর তাই আমি নাম ধরে এই পত্রিকা ও এর দায়িত্বশীলদের নিয়ে কথা বলতে দ্বিধাবোধ করি। অধুনা আল কাওসারে “নারীর চেহারা পর্দার গুরুত্বপূর্ণ অংশ একটি দালীলিক বিশ্লেষণ” নামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করা হয়েছে। সামাজিক মাধ্যমে আমাকে অনুসরণ করেন এমন অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী এই প্রবন্ধ সম্পর্কে আমাকে বেশ কয়েকবার কিছু বলার অনুরোধ করেছেন। কেবল এই পীড়াপীড়ি থেকেই আমি এই নিয়ে লিখতে বাধ্য হলাম।
প্রশ্ন: নারীরা পরপুরুষের সামনে কেন তাদের চেহারা ঢেকে রাখবে?
আল্লাহ নবির মাধ্যমে আমাদের কাছে ইসলামি শরিয়ত পাঠিয়েছেন। এই শরিয়তে আমাদের জন্য করণীয়, পরিহার্য এবং ঐচ্ছিক এই তিন প্রকারের বিধান আছে। করণীয়র মধ্যে রয়েছে দুই ভাগ — বাধ্যতামূলক, যাকে বলা হয় ফরজ, এবং উৎসাহমূলক, যাকে বলা হয় মুস্তাহাব। একইভাবে পরিহার্য দুই প্রকার — বাধ্যতামূলকভাবে পরিহার্য, যাকে বলা হয় হারাম এবং উৎসাহমূলকভাবে পরিহার্য, যাকে মাকরুহ বা অপছন্দনীয়। আর যেসব বিষয় করা কিংবা না করা বান্দার জন্য সমান, তা হল মুবাহ বা জায়েজ। শরিয়তের যেকোন বিধান এই পাঁচ প্রকারের কোন একটিতে অবশ্যই পড়বে। মুবাহ হল মাঝামাঝি। ডানে হল মুস্তাহাব, তারও ডানে ফরয। আর মুবাহের বামে মাকরুহ। আরো বামে হারাম। কোন একটা কাজকে মুবাহ/জায়েজ বাদে অন্য কোন ক্যাটাগরিতে ফেলার অর্থ, শরিয়তের নিক্তি ডানে কিংবা বামে ঝুঁকেছে বলা। আর নিক্তি ডানে-বামে তখনই ঝোঁকে, তখন তার পক্ষে দলিল-প্রমাণ থাকে। নারীরা পরপুরুষের সামনে চেহারা ঢেকে রাখবে এই কথাটা দ্বারা করণীয় বোঝায়। আর করণীয় যেহেতু দুই প্রকার, তাহলে প্রশ্ন হল — কোন প্রকারের করণীয় এটা? বাধ্যতামূলক, যা না করলে গুনাহ হবে। নাকি মুস্তাহাব, করলে উত্তম, না করলে গুনাহ নেই?
তো যারা বলেন এটা বাধ্যতামূলক, তাদেরকে অবশ্যই এর পক্ষে দলিল দিতে হবে। আর সেই দলিলটিও হতে হবে অকাট্য কিংবা পর্যাপ্ত শক্তিশালী। দলিল হিসেবে এমন কিছু উপস্থাপন করা যাবে না যা একাধিক ব্যাখ্যার সম্ভাবনা রাখে। হ্যাঁ, আপনি ব্যক্তিগত পর্যায়ে একাধিক ব্যাখ্যার মধ্য থেকে যেকোন একটাকে মেনে নেন, আপনার পারসোনাল লাইফে কী করেন-না করেন তা নিয়ে অন্যদের মাথাব্যাথা নাই। কিন্তু আপনি যদি আপনার ব্যাক্তিগত পছন্দকে অন্যের উপর চাপিয়ে দিতে চান, তাহলে অবশ্যই যথেষ্ট শক্তিশালী দলিল আনতে হবে যার পর অন্যের কাছে সেটা মেনে নেয়া ছাড়া কোন উপায় থাকে না।
কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, يريد الله بكم اليسر ولا يريد بكم العسر “আল্লহ তোমাদের জন্য সহজ চান, কঠিন চান না।” (বাকারা, ১৮৫) তো কেন আমরা সহজ ছেড়ে কঠিনের দিকে যাব, যদি সেই কঠিন মতের পক্ষে যথেষ্ট শক্তি না থাকে?
নারীদের চেহারা ঢেকে রাখার পক্ষে যারা তর্ক করেন, তাদের সমস্ত কথাবার্তা গিয়ে কোরআনের দুই আয়াতে গিয়ে ঠেকে।
১. সুরা নুর, আয়াত ৩১
وَقُل لِّلْمُؤْمِنَاتِ يَغْضُضْنَ مِنْ أَبْصَارِهِنَّ وَيَحْفَظْنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا
“মুমিন নারীদের বলুন তাদের দৃষ্টি সংবরণ করতে, তাদের লজ্জাস্থান সুরক্ষিত রাখতে এবং তাদের সৌন্দর্য/অলঙ্কার উন্মুক্ত না করতে, তবে যা প্রকাশ্যমান তা বাদে।”
২. সুরা আহযাব, আয়াত ৫৯
يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ قُل لِّأَزْوَاجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَاءِ الْمُؤْمِنِينَ يُدْنِينَ عَلَيْهِنَّ مِن جَلَابِيبِهِنَّ ۚ ذَٰلِكَ أَدْنَىٰ أَن يُعْرَفْنَ فَلَا يُؤْذَيْنَ
“নবী, আপনি নিজের স্ত্রীদের, নিজের কন্যাদের এবং মুমিন নারীদের বলুন তারা যেন তাদের জিলবাব নিজেদের ওপর টেনে নেয়। চিহ্নিত হতে এবং কষ্ট থেকে বাঁচতে এটাই নিকটতম উপায়।”
তো প্রথম আয়াত থেকে জানা যাচ্ছে, নারীদের সৌন্দর্য কিংবা অলঙ্কার (আরবিতে যিনাত শব্দের দুই অর্থই হয়) ঢেকে রাখতে হবে, তবে যা প্রকাশ্যমান থাকে, তা বাদে। আমরা বলি, এই প্রকাশ্যমান সৌন্দর্য হল নারীদের চেহারা ও হাতের মুঠো। তাই কোরআনের আয়াত অনুযায়ী, নারীদের জন্য তাদের চেহারা খোলা নিষিদ্ধতার অন্তর্ভূক্ত নয়। আমাদের প্রতিপক্ষ এটা মানতে নারাজ। তারা বলে, না, এখানে প্রকাশ্যমান বলতে বোঝানো হয়েছে, নারীর পোশাক। অর্থাৎ সারা শরীর ঢেকে রাখার পরও তো নারীর পোশাক দেখা যাবে। ওটা দেখাই কেবল জায়েজ।
আপত্তির জায়গা
যদি তাদের কথা এই পর্যন্ত থামত, তাহলে আমাদের কিছু একটা বলার ছিল না। কারণ সাহাবি ও তাবেয়িদের কেউ কেউ কোরআনের আয়াতের এমন ব্যাখ্যা করেছেন। তাই মতভেদের প্রতি উদারতার জায়গা থেকে, আমরা তাদেরকে ছাড় দিতে পারতাম। কিন্তু সমস্যা হল, তারা সংখ্যাগরিষ্ট সাহাবি, তাবেয়ির তাফসিরকে ভিত্তিহীন ঘোষণা দেয়। আর যারা সেই তাফসির মানে, তাদেরকে খারাপ খারাপ শব্দে অভিহিত করে। আমাদের আপত্তি এখানেই।
এছাড়াও আমাদের আপত্তি হচ্ছে, তারা নিজেদের হানাফি মাযহাব অনুসারী দাবি করে। কিন্তু হানাফি মাযহাবের প্রতিষ্ঠাতা আবু হানিফা এবং তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুই ছাত্র আবু ইউসুফ ও মুহাম্মদের বক্তব্যকে এখানে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে। কথা হচ্ছে, আপনারা চেহারা ঢাকা ফরজ বলার ক্ষেত্রে নিজেদের হাম্বলি দাবি করেন কিংবা আহলে হাদিস দাবি করেন, হাম্বলি মাযহাবের মশহুর অনুযায়ী চেহারা ঢাকা ফরজ, কিন্তু কেন আপনারা এই মতকে ইমামে আযম আবু হানিফা ও সাহেবাইনের উপর দিয়ে চালাতে চান? কেন আপনারা মানুষকে হানাফি মাযহাবের নাম নিয়ে মিথ্যা বলেন?
সুরা নুরের ৩১ নং আয়াতের তাফসির স্বয়ং ইমাম মুহাম্মদ তার শিক্ষক ইমাম আবু হানিফার কাছ থেকে উল্লেখ করেছেন। সেটা কেন আপনারা একবারও উল্লেখ করেন না? এমন ভাব নেন যেন এই বিষয়ে আবু হানিফা কিংবা তার শীর্ষ দুই ছাত্রের কিছুই বলার ছিল না?
ইমাম আবু হানিফার ছাত্র মুহাম্মদ বিন হাসান আশ শায়বানি তার আল মাবসুত কিতাবে লেখেন,
وأما المَرْأة الحرَّة الَّتِي لا نِكاح بَينه وبَينها ولا حُرْمَة مِمَّن يحل لَهُ نِكاحها فَلَيْسَ يَنْبَغِي لَهُ أن ينظر إلى شَيْء مِنها مكشوفا إلّا الوَجْه والكف والكف ولا بَأْس بِأن ينظر إلى وجهها وإلى كفها ولا ينظر إلى شَيْء غير ذَلِك مِنها وهَذا قَول أبي حنيفَة وقالَ الله تبارك وتعإلى ﴿وقل للمؤمنات يغضضن من أبصارهن ويحفظن فروجهن ولا يبدين زينتهن إلّا ما ظهر مِنها﴾ ففسر المُفَسِّرُونَ أن ما ظهر مِنها الكحل والخاتم والكحل زِينَة الوَجْه والخاتم زِينَة الكَفّ فَرخص فِي هاتين الزينتين ولا بَأْس بِأن ينظر إلى وجهها وكفها إلّا أن يكون إنَّما ينظر إلى ذَلِك اشتهاء مِنهُ لَها فان كانَ ذَلِك فَلَيْسَ يَنْبَغِي لَهُ أن ينظر إلَيْهِ وإن دعِي إلى شَهادَة عَلَيْها أو أرادَ تَزْوِيجها أو كانَ حاكما فَأرادَ أن ينظر إلى وجهها وكفها ليجيز إقْرارها عَلَيْها وليشهد الشُّهُود على مَعْرفَتها وإن كانَ إن نظر إلَيْها أو كانَ عَلَيْهِ أكبر رَأْيه فَلا بَأْس بِالنّظرِ إلى وجهها وإن كانَ على ذَلِك لِأنَّهُ لم ينظر إلَيْها هَهُنا ليشتهيها إنَّما النّظر إلَيْها لغير ذَلِك فَلا بَأْس بِالنّظرِ إلَيْها وإن كانَ فِي ذَلِك شَهْوَة إذا كانَ على ما وصفت لَك
স্বাধীন নারী যার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক নেই এবং সে মাহরামও না অর্থাৎ তাকে বিয়ে করা বৈধ, এমন নারীর কোন অঙ্গই উন্মুক্ত অবস্থায় দেখা অনুচিত, তবে চেহারা ও হাতের মুঠো বাদে। চেহারা ও হাতের মুঠোর দিকে তাকাতে সমস্যা নেই। কিন্ত এছাড়া আর কিছুর দিকে তাকাবে না। এটাই আবু হানিফার বক্তব্য। কারণ আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, মুমিন নারীদের বলুন তাদের দৃষ্টি সংবরণ করতে, তাদের লজ্জাস্থান সুরক্ষিত রাখতে এবং তাদের সৌন্দর্য/অলঙ্কার উন্মুক্ত না করতে, তবে যা প্রকাশ্যমান তা বাদে। মুফাসসিরগণ বলেছেন, যা প্রকাশ্যমান তা হল - কাজল ও আংটি। কাজল চেহারার অলঙ্কার। আংটি হাতের মুঠোর। আল্লাহ এই দুই ক্ষেত্রে ছাড় দিয়েছেন। তাই চেহারা ও হাতের মুঠোর দিকে তাকাতে কোন সমস্যা নেই যদি এতে নারীর প্রতি শাহওয়াত বা কামভাব যুক্ত না থাকে। যদি এটা থাকে, তবে তার দিকে তাকানো উচিত না। কিন্তু যদি সাক্ষ্য দিতে কিংবা তাকে বিয়ে করতে তাকে ডাকা হয়, কিংবা সে বিচারক হয় আর তার বক্তব্যকে স্বীকৃতি দিতে তার চেহারার দিকে তাকানো প্রয়োজন হয়, কিংবা তার ব্যাপারে সাক্ষ্য দেয়ার জন্য তার পরিচিতি সাক্ষীদের জানা দরকার হয়, তবে এমন পরিস্থিতিতে কামভাবের উপস্থিতিসহ তার চেহারার দিকে তাকাতে কিংবা উপস্থিতির ব্যাপারে প্রবল ধারণাসহ তাকাতে সমস্যা নেই। কারণ তার তাকানোর উদ্দেশ্য এখানে কামলিপ্সা নয়, বরং অন্য উদ্দেশ্যে সে তাকাচ্ছে। তাই এমন ক্ষেত্রে কামভাব নিয়ে আমাদের বিবরণ অনুযায়ী তাকাতে কোন সমস্যা নেই।
সুত্র: আল মাবসুত, ৩/৫৬-৫৮
এখানে আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, হানাফি মাযহাব অনুযায়ী এই আয়াতের সঠিক তাফসির হচ্ছে চেহারা ও হাতের মুঠো উন্মুক্ত রাখা যাবে। আর এর ভিত্তিতেই হানাফি মাযহাব প্রতিষ্ঠিত। এছাড়াও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, সাধারণ ও স্বাভাবিক দৃষ্টিতে নারীর চেহারার দিকে তাকাতে কোন সমস্যা নেই, এটা ইমাম মুহাম্মদ বারবার করে বলেছেন। কামভাব নিয়ে তাকানোর ক্ষেত্রেই কেবল বলেছেন, একমাত্র বাধ্য হলে কামভাব সহ তাকানো যাবে। এদিকে আমাদের প্রতিপক্ষরা বলে, কামভাব না থাকুক, নারীর চেহারার দিকে তাকানো যাবে না। তাদের মতে, কামভাব ছাড়া তাকানোর অনুমতিও কেবল একান্ত অপারগতা ও যরুরতে পড়ে গেলে। সুস্পষ্টভাবেই, এটা হানাফি মাযহাবের লঙ্ঘন।
এবার আসা যাক, ইমাম তাহাবির কাছে, যিনি ছিলেন ‘শায়খুল হানাফিয়া’ ইবনে আবি ইমরানের ছাত্র। আর তিনি ছিলেন আবু ইউসুফের ছাত্রদের ছাত্র। অর্থাৎ আবু হানিফা ও ইমাম তাহাবির মধ্যে কেবল তিনজন শিক্ষক আছেন। ইমাম তাহাবির বিখ্যাত গ্রন্থ শারহু মা’আনিল আসার হানাফি ফিকহের আকর গ্রন্থগুলোর একটি।
তাহাবি বলেন,
فَكَذَلِكَ نَظَرُهُ إلى وجْهِ المَرْأةِ إنْ كانَ فَعَلَ ذَلِكَ لِمَعْنًى هُوَ حَلالٌ، فَذَلِكَ غَيْرُ مَكْرُوهٍ لَهُ، وإنْ كانَ فَعَلَهُ لِمَعْنًى هُوَ عَلَيْهِ حَرامٌ، فَذَلِكَ مَكْرُوهٌ لَهُ، وإذا ثَبَتَ أنَّ النَّظَرَ إلى وجْهِ المَرْأةِ لِيَخْطُبَها حَلالٌ، خَرَجَ بِذَلِكَ حُكْمُهُ مِن حُكْمِ العَوْرَةِ، ولِأنّا رَأيْنا ما هُوَ عَوْرَةٌ لا يُباحُ لِمَن أرادَ نِكاحَها النَّظَرُ إلَيْها. ألا تَرى أنَّ مَن أرادَ نِكاحَ امْرَأةٍ، فَحَرامٌ عَلَيْهِ النَّظَرُ إلى شَعْرِها، وإلى صَدْرِها، وإلى ما هُوَ أسْفَلَ مِن ذَلِكَ فِي بَدَنِها، كَما يَحْرُمُ ذَلِكَ مِنها، عَلى مَن لَمْ يُرِدْ نِكاحَها. فَلَمّا ثَبَتَ أنَّ النَّظَرَ إلى وجْهِها حَلالٌ لِمَن أرادَ نِكاحَها، ثَبَتَ أنَّهُ حَلالٌ أيْضًا لِمَن لَمْ يُرِدْ نِكاحَها، إذا كانَ لا يَقْصِدُ بِنَظَرِهِ ذَلِكَ لِمَعْنًى هُوَ عَلَيْهِ حَرامٌ. وقَدْ قِيلَ فِي قَوْلِ اللهِ ﷿: ﴿ولا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إلّا ما ظَهَرَ مِنها﴾ [النور ٣١]: إنَّ ذَلِكَ المُسْتَثْنى هُوَ الوَجْهُ والكَفّانِ، فَقَدْ وافَقَ ما ذَكَرْنا مِن حَدِيثِ رَسُولِ اللهِ صَلّى الله عَلَيْهِ وعَلى آلِهِ وسَلَّمَ هَذا التَّأْوِيلَ. ومِمَّنْ ذَهَبَ إلى هَذا التَّأْوِيلِ مُحَمَّدُ بْنُ الحَسَنِ رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِ. كَما حَدَّثَنا سُلَيْمانُ بْنُ شُعَيْبٍ بِذَلِكَ، عَنْ أبِيهِ، عَنْ مُحَمَّدٍ. وهَذا كُلُّهُ قَوْلُ أبِي حَنِيفَةَ، وأبِي يُوسُفَ، ومُحَمَّدٍ، رَحْمَةُ اللهِ عَلَيْهِمْ أجْمَعِينَ
একইভাবে নারীর চেহারার দিকে তাকানো যদি হালাল উদ্দেশ্যে হয়, তবে তা তার জন্য মাকরুহ বা অপছন্দনীয় না। কিন্তু যদি হারাম উদ্দেশ্যে তাকায়, তবে এটা তার জন্য মাকরুহ। এটা সাব্যস্ত হবার পর কথা হচ্ছে, যেহেতু বিয়ের উদ্দেশ্যে কোন নারীর চেহারর দিকে তাকানো হালাল, সেহেতু চেহারা আওরাত বা গোপনীয় অঙ্গের বহির্ভূত হয়ে গেল। কেননা আওরাতের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ্য করেছি, বিয়ের উদ্দেশ্যেও এর দিকে তাকানো বৈধ নয়। তুমি কি দেখছ না যে, বিয়ের উদ্দেশ্যে হলেও নারীর চুল কিংবা বুক কিংবা তার নিম্নাঙ্গের দিকে তাকানো হারাম? বিয়ে করতে যে চায়, তার জন্যও যেমন এটা হারাম, তেমনি বিয়ে করতে চায় না, তার জন্যও হারাম। তাই যেহেতু প্রমাণিত আছে, বিয়ের উদ্দেশ্যে নারীর চেহারার দিকে তাকানো হালাল, সেহেতু এটাও প্রমাণিত হল, বিয়ের উদ্দেশ্য যার নেই, তার জন্যও তাকানো হালাল। শর্ত হচ্ছে কোন হারাম উদ্দেশ্য নিয়ে তাকানো যাবে না। কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, প্রকাশ্যমান যা তা ব্যতীত উন্মুক্ত করো না এর তাফসিরে বলা হয়েছে, চেহারা ও দুই হাতের মুঠোকে ব্যাতিক্রম করা হয়েছে। সুতরাং রাসুলের হাদিসের যে ব্যাখ্যা আমরা দিলাম, তা এর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। এছাড়াও এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করেছেন মুহাম্মদ বিন হাসান। আর এর সবই আবু হানিফা, আবু ইউসুফেরও বক্তব্য। আল্লাহ তাদের উপর সন্তুষ্ট হউন।
সুত্র: শারহু মা’আনিল আসার, ৩/১৫।
ইমাম তাহাবি আরো বলেছেন, চেহারা ঢেকে রাখার বিধানটি বিশেষভাবে কেবল নবির স্ত্রীদের জন্য প্রযোজ্য। তিনি বলেন,
فَأُبِيحَ لِلنّاسِ أنْ يَنْظُرُوا إلى ما لَيْسَ بِمُحَرَّمٍ عَلَيْهِمْ مِنَ النِّساءِ إلى وُجُوهِهِنَّ، وأكُفَّهُنَّ، وحَرُمَ ذَلِكَ عَلَيْهِمْ مِن أزْواجِ النَّبِيِّ ﷺ لَمّا نَزَلَتْ آيَةُ الحِجابِ، فَفُضِّلْنَ بِذَلِكَ عَلى سائِرِ النّاسِ - حَدَّثَنا أبُو بَكْرَةَ وابْنُ مَرْزُوقٍ قالا: ثنا عَبْدُ اللهِ بْنُ بُكَيْرٍ السَّهْمِيُّ قالَ: ثنا حُمَيْدٌ عَنْ أنَسٍ قالَ: قالَ عُمَرُ: قُلْتُ: «يا رَسُولَ اللهِ، يَدْخُلُ عَلَيْكَ البَرُّ والفاجِرُ، فَلَوْ حَجَبْتَ أُمَّهاتِ المُؤْمِنِينَ، فَأنْزَلَ اللهُ آيَةَ الحِجابِ»
মানুষের জন্য অনুমতি দেয়া হয়েছে যে, তারা নারীদের চেহারা ও হাতের মুঠোর দিকে তাকাতে পারবে। কিন্তু নবির স্ত্রীদের ক্ষেত্রে তাকানো নিষিদ্ধ যেহেতু তাদের ব্যাপারে হিজাবের আয়াত নাযিল হয়েছে এবং সকলের উপর তাদের বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়েছে। আমাদের আবু বুকরা বলেছেন, তিনি … হযরত উমর বলেন, আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আপনার ঘরে ভালো, মন্দ সব মানুষই আসে। যদি মুমিনদের মায়ের জন্য হিজাব গ্রহণ করত! আর এই মর্মেই হিজাবের আয়াত নাযিল হয়।
সুত্র: শারহু মা’আনিল আসার, ৪/৩৩২।
এখানে বলে রাখা ভাল যে, হিজাব শব্দের মূল অর্থ ব্যবধান, পর্দা, আড়াল। মানুষ বর্তমানে মেয়েদের লম্বা পোশাককে হিজাব বললেও আয়াতে হিজাবের অর্থ হল দেয়াল কিংবা পর্দার ওপাড়ে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা।
এই আয়াতের ব্যাপারে সর্বশেষে আরেক হানাফি ফকিহ, ইমাম জাসসাসের বক্তব্য তার আহকামুল কোরআন গ্রন্থ থেকে উল্লেখ করা যাক। তিনি বলেন,
قَوْله تَعالى: ﴿ولا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إلّا ما ظَهَرَ مِنها﴾ وقالَ أصْحابُنا: المُرادُ الوَجْهُ والكَفّانِ؛ لِأنَّ الكُحْلَ زِينَةُ الوَجْهِ والخِضابَ والخاتَمَ زِينَةُ الكَفِّ، فَإذْ قَدْ أباحَ النَّظَرَ إلى زِينَةِ الوَجْهِ والكَفِّ فَقَدْ اقْتَضى ذَلِكَ لا مَحالَةَ إباحَةَ النَّظَرِ إلى الوَجْهِ والكَفَّيْنِ. ويَدُلُّ عَلى أنَّ الوَجْهَ والكَفَّيْنِ مِن المَرْأةِ لَيْسا بِعَوْرَةٍ أيْضًا أنَّها تُصَلِّي مَكْشُوفَةَ الوَجْهِ واليَدَيْنِ، فَلَوْ كانا عَوْرَةً لَكانَ عَلَيْها سَتْرُهُما كَما عَلَيْها سَتْرُ ما هُوَ عَوْرَةٌ؛ وإذا كانَ كَذَلِكَ جازَ لِلْأجْنَبِيِّ أنْ يَنْظُرَ مِن المَرْأةِ إلى وجْهِها ويَدَيْها بِغَيْرِ شَهْوَةٍ، فَإنْ كانَ يَشْتَهِيها إذا نَظَرَ إلَيْها جازَ أنْ يَنْظُرَ لِعُذْرٍ مِثْلَ أنْ يُرِيدَ تَزْوِيجَها أوْ الشَّهادَةَ عَلَيْها أوْ حاكِمٌ يُرِيدُ أنْ يَسْمَعَ إقْرارَها. ويَدُلُّ عَلى أنَّهُ لا يَجُوزُ لَهُ النَّظَرُ إلى الوَجْهِ لِشَهْوَةٍ قَوْلُهُ ﷺ لِعَلِيٍّ: «لا تُتْبِعْ النَّظْرَةَ النَّظْرَةَ فَإنَّ لَك الأُولى ولَيْسَ لَك الآخِرَةَ»، وسَألَ جَرِيرٌ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ عَنْ نَظْرَةِ الفُجاءَةِ فَقالَ: «اصْرِفْ بَصَرَك» ولَمْ يُفَرِّقْ بَيْنَ الوَجْهِ وغَيْرِهِ، فَدَلَّ عَلى أنَّهُ أرادَ النَّظْرَةَ بِشَهْوَةٍ؛ وإنَّما قالَ: «لَك الأُولى»؛ لِأنَّها ضَرُورَةٌ: «ولَيْسَ لَك الآخِرَةُ»؛ لِأنَّها اخْتِيارٌ.
আল্লাহ বলেছেন, প্রকাশ্যমান যা তা ব্যতীত উন্মুক্ত করো না আমাদের মাযহাবের আলেমগণ বলেছেন, এর অর্থ হল চেহারা ও দুই হাতের মুঠো। আর অবধারিতভাবে এই আয়াতের দাবি হচ্ছে, চেহারা ও দুই হাতের মুঠোর দিকে তাকানোর বৈধতা। এই দুই অঙ্গ যে গোপনীয় (আওরাত) নয়, তার পক্ষে আরো দলিল হচ্ছে, নারী চেহারা ও হাতের মুঠো উন্মুক্ত করে নামায পড়ে, যদি এই অঙ্গগুলো গোপনীয় হত, তাহলে এগুলো ঢেকে রাখা তার জন্য আবশ্যক হত, যেভাবে আওরাত ঢেকে রাখা তার জন্য আবশ্যক। বিষয় যদি এমনই হয়, তাহলে পরপুরুষের জন্যও কামভাব ছাড়া নারীর চেহারা ও দুই হাতের দিকে তাকানো জায়েয। কিন্তু যদি কামভাব থাকে, তাহলে ওজর-অপারগতা বশত তাকানো বৈধ হবে, যেমন সে বিয়ে করতে চায়, কিংবা আদালতে সাক্ষ্য দিতে চায় কিংবা বিচারক তাকে দেখে তার বক্তব্যের স্বীকৃতি দিতে চায়। আর কামভাব নিয়ে তাকানো যে জায়েজ না, তা জানা যায় আলীর হাদিস থেকে। রাসুল আলীকে বলেছিলেন, ‘'প্রথম দৃষ্টির পর দ্বিতীয় দৃষ্টি দিও না। কেননা প্রথমটা তোমার জন্য, শেষেরটা তোমার বিরুদ্ধে।” এছাড়াও জারির রাসুলকে আকস্মিক দৃষ্টির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, “তোমার চোখ সরাও”। এক্ষেত্রে তিনি চেহারা ও অন্য অঙ্গের মাঝে ফারাক করেন নি। বরং বলেছেন, “প্রথমটা তোমার জন্য” কারণ এটা অপারগতাবশত। “শেষেরটা তোমার বিরুদ্ধে” কারণ এটা ইচ্ছাকৃত।
وإنَّما أباحُوا النَّظَرَ إلى الوَجْهِ والكَفَّيْنِ وإنْ خافَ أنْ يَشْتَهِيَ لِما ذَكَرْنا مِن الأعْذارِ لِلْآثارِ الوارِدَةِ فِي ذَلِكَ، كُلُّهُ يَدُلُّ عَلى جَوازِ النَّظَرِ إلى وجْهِها وكَفِّها بِشَهْوَةٍ إذا أرادَ أنْ يَتَزَوَّجَها، ويَدُلُّ عَلَيْهِ أيْضًا قَوْلُهُ: ﴿لا يَحِلُّ لَكَ النِّساءُ مِن بَعْدُ ولا أنْ تَبَدَّلَ بِهِنَّ مِن أزْواجٍ ولَوْ أعْجَبَكَ حُسْنُهُنَّ﴾ [الأحزاب ٥٢] ولا يُعْجِبُهُ حُسْنُهُنَّ إلّا بَعْدَ رُؤْيَةِ وُجُوهِهِنَّ. ويَدُلُّ عَلى أنَّ النَّظَرَ إلى وجْهِها بِشَهْوَةٍ مَحْظُورٌ قَوْلُهُ ﷺ: «العَيْنانِ تَزْنِيانِ واليَدانِ تَزْنِيانِ والرِّجْلانِ تَزْنِيانِ ويُصَدِّقُ ذَلِكَ كُلَّهُ الفَرْجُ أوْ يُكَذِّبُهُ». وقَوْلُ ابْنِ مَسْعُودٍ فِي أنَّ ما ظَهَرَ مِنها هُوَ الثِّيابُ لا مَعْنى لَهُ؛ لِأنَّهُ مَعْلُومٌ أنَّهُ ذَكَرَ الزِّينَةَ والمُرادُ العُضْوُ الَّذِي عَلَيْهِ الزِّينَةُ، ألا تَرى أنَّ سائِرَ ما تَتَزَيَّنُ بِهِ مِن الحُلِيِّ والقُلْبِ والخَلْخالِ والقِلادَةِ يَجُوزُ أنْ تُظْهِرَها لِلرِّجالِ إذا لَمْ تَكُنْ هِيَ لابِسَتُها؟ فَعَلِمْنا أنَّ المُرادَ مَوْضِعُ الزِّينَةِ كَما قالَ فِي نَسَقِ التِّلاوَةِ بَعْدَ هَذا: ﴿ولا يُبْدِينَ زِينَتَهُنَّ إلّا لِبُعُولَتِهِنَّ﴾ والمُرادُ مَوْضِعُ الزِّينَةِ، فَتَأْوِيلُها عَلى الثِّيابِ لا مَعْنى لَهُ؛ إذْ كانَ ما يَرى الثِّيابَ عَلَيْها دُونَ شَيْءٍ مِن بَدَنِها كَما يَراها إذا لَمْ تَكُنْ لابِسَتَها.
কামভাবের আশঙ্কা সত্তেও চেহারা ও হাতের মুঠোর দিকে তাকানোর বৈধতা হানাফি আলেমরা দিয়েছেন আমাদের উল্লিখিত ওজরগুলো থাকলে যেহেতু এ ব্যাপারে অনেক বর্ণনা এসেছে। যার সবই নির্দেশ করে যে, বিয়ের উদ্দেশ্যে হলে, কামভাবসহ তাকানো জায়েজ। এছাড়াও এর পক্ষে দলিল হল কোরআনের আয়াত “তোমার জন্য এরপর কোন নারীকে বিবাহ করা বৈধ নয়, বর্তমান স্ত্রীদের জায়গায় অন্য কাউকে নিয়ে আসাও বৈধ নয়, যদিও তাদের সৌন্দর্য তোমাকে আকর্ষণ করে। (আহযাব ৫২) আর সৌন্দর্যের আকর্ষণ চেহারা না দেখে কখনোই আসে না। আর (স্বাভাবিক অবস্থায়) কামভাব নিয়ে চেহারার দিকে তাকানো নিষিদ্ধতার পক্ষে দলিল হল, এই হাদিস চোখ যিনা করে, হাত যিনা করে, পা যিনা করে, আর লজ্জাস্থান একে সত্যে পরিণত করে কিংবা মিথ্যায়। এখন ইবনে মাসউদ আয়াতের যে তাফসির করেছেন “যা প্রকাশ্যমান তা ব্যতীত দ্বারা পোশাক বোঝায়” এটা অর্থহীন কথা। কারণ আয়াতে স্পষ্টই যিনাত বা অলঙ্কারের কথা আছে, আর এর উদ্দেশ্য হল যেসব অঙ্গে অলঙ্কার পরা হয় সেসব অঙ্গ। তুমি কি দেখ না যে, নারীরা সৌন্দর্যের জন্য যা যা পরে - পোশাক, নুপুর, নেকলেস এগুলো সবই পুরুষের সামনে প্রকাশ করা বৈধ যদি সে নিজে এগুলো গায়ে পরে না থাকে? তাহলে বোঝা গেল যে, অলঙ্কার বলে এখানে খোদ অলঙ্কার নয়, বরং অলঙ্কারের জায়গা বোঝানো হয়েছে। এছাড়াও আয়াতের ধারাবাহিকতায় তোমাদের অলঙ্কার স্বামীদের ছাড়া প্রকাশ করো না কথা এসেছে, সুতরাং বোঝা যাচ্ছে এখানে যিনাত বলে অলঙ্কারের স্থান বোঝানো হচ্ছে। সুতরাং যিনাতকে পোশাক দিয়ে ব্যাখ্যা করলে কোন অর্থ দাঁড়ায় না। কারণ শরীরের কোন অঙ্গ ছাড়া পোশাক দেখা তো অপরিহিত অবস্থায় পোশাককে দেখার সমান। (এটা আলাদা করে বলার তো কিছু নেই।)
সুত্র: আহকামুল কোরআন, ৩/৪০৮-৯।
হানাফি ফুকাহা ও মুফাসসিরদের বক্তব্য এই বিষয়ে চাইলে আরো অনেক আনা যাবে। কিন্তু কলেবর বাড়াতে চাচ্ছি না। তাই আর দিচ্ছি না। উপরের আলোচনার পর কোন সন্দেহ থাকার অবকাশ থাকে না যে, কামভাব ছাড়া নারীর চেহারার দিকে তাকানো জায়েজ। অর্থাৎ খোদ নারীর চেহারার মাঝে এমন কোন ইল্লাত, গুণ বা কারণ উপস্থিত নেই, যার কারণে সত্তাগতভাবে (in itself) চেহারা খোলা কিংবা চেহারা দেখা নাজায়েয হবে। চেহারা আওরত নয়, তাই এটা ঢেকে রাখা বাধ্যতামূলক নয়। একই কারণে চেহারার দিকে তাকানোও নাজায়েয নয়, কারণ খোদ চেহারাতে তাকানোর মাঝে কোন সমস্যা বিদ্যমান নেই। সমস্যা যদি থাকে সেটা চেহারা এবং তাকানো এই দুই বিষয়ের বাইরে থেকে আসবে। যেমন কামভাব নিয়ে চিন্তা করুন। কামভাব দৃষ্টির ভেতরে থাকে না, কামভাব থাকে পুরুষের অন্তরে।
আর এই কারণেই আল্লামা ইবনে আবেদীন আল হানাফি তার রদ্দুল মুহতারে লিখেছেন,
بَيَانُ الشَّهْوَةِ الَّتِي هِيَ مَنَاطُ الْحُرْمَةِ أَنْ يَتَحَرَّكَ قَلْبُ الْإِنْسَانِ وَيَمِيلُ بِطَبْعِهِ إلَى اللَّذَّةِ، وَرُبَّمَا انْتَشَرَتْ آلَتُهُ إنْ كَثُرَ ذَلِكَ الْمَيَلَانُ؛ وَعَدَمُ الشَّهْوَةِ أَنْ لَا يَتَحَرَّكَ قَلْبُهُ إلَى شَيْءٍ مِنْ ذَلِكَ بِمَنْزِلَةِ مَنْ نَظَرَ إلَى ابْنِهِ الصَّبِيحِ الْوَجْهُ وَابْنَتِهِ الْحَسْنَاءِ
দৃষ্টিপাতের হারাম হবার বিষয়টি শাহওয়াত বা কামোত্তেজনার উপর নির্ভরশীল, এর বিবরণ হচ্ছে: অন্তর চঞ্চল হয়ে ওঠা এবং শারীরিক আকর্ষণ থেকে স্বাদ অনুভব করা, যা থেকে তার লিঙ্গ প্রশস্ত হয়ে উঠতে পারে। আর কামভাবের অনুপস্থিতি হচ্ছে, মনে কোন চঞ্চলতা সৃষ্টি না হওয়া। নিজের সুদর্শন ছেলে কিংবা সুন্দরী মেয়েকে দেখলে, মনের যে অবস্থা থাকে সে অবস্থাই বিরাজ করা।
তো আমরা বাহ্যিক কারণের কথা বলছিলাম। যদি এমন হয় যে, নারী তার চেহারা খোলা রাখার কারণে ক্ষতির আশঙ্কার মুখোমুখি হয়, দুশ্চরিত্র লোকদের খপ্পরে পড়ে যায়, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সুত্রপাতের সমূহ সম্ভাবনা থাকে, তখনও কি চেহারা খোলা রাখা সঠিক হবে? অবশ্যই না। আমি কোনদিনও আমার অধীনস্থ কোন মেয়েকে এই অনুমতি দিব না যার কারণে তার নিরাপত্তা বিঘ্নিত হয়, সমাজের নিকৃষ্ট লোকদের লক্ষ্যে পরিণত হোক। শরিয়তে সদ্দে যরিয়াহ নামক একটি ধারণা আছে। এর তাৎপর্য হল, কোন একটা জায়েয ও হালাল কাজ যদি হারাম কিংবা মাফসাদা অর্থাৎ ক্ষতির কারণ হয়, তবে সেই ক্ষতি থেকে বাঁচতে কাজটি করতে বাঁধা দেয়া।
সদ্দে যরিয়াহ
এবার চলুন, সুরা আহযাবের ৫৯ নং আয়াত নিয়ে কথা বলা যাক। আমাদের দাবি হচ্ছে, চেহারা খোলা রাখা এবং চেহারার দিকে তাকানোর আসল বা মূল হুকুম হল — বৈধতা। কিন্তু, যদি কোন ক্ষতির আশঙ্কা থাকে, তবে সেই ক্ষতির আশঙ্কাকে বিবেচনায় নিয়ে সাময়িকভাবে চেহারা ঢাকতে কিংবা চেহারার দিকে তাকাতে নিষেধ করা হবে। সাময়িক বলা কারণ হল, ক্ষতির আশঙ্কা যখন থাকবে না, নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে, তখন আবার মূল হুকুমে ফেরত আসতে হবে। আয়াতটি যে সদ্দে যরিয়াহ হিসেবেই এসেছে, চেহারা আওরাত বা গোপনীয় বোঝাতে আসে নি, তা আমরা মুফাসসিরদের নিচের বক্তব্য থেকে বুঝতে পারি।
এই আয়াত সম্পর্কে আহকামুল কোরআনে ইমাম জাসসাস লিখেছেন,
فِي هَذِهِ الآيَةِ دَلالَةٌ عَلى أنَّ المَرْأةَ الشّابَّةَ مَأْمُورَةٌ بِسَتْرِ وجْهِها عَنْ الأجْنَبِيِّينَ وإظْهارِ السِّتْرِ والعَفافِ عِنْدَ الخُرُوجِ لِئَلّا يَطْمَعَ أهْلُ الرِّيَبِ فِيهِنَّ.
এই আয়াতে নির্দেশ রয়েছে যে, যুবতী নারীরা যখন পরপুরুষের সামনে বের হবে তখন সে নিজের পর্দানশীলতা ও সতিত্ব জাহের করতে তাদেরকে চেহারা ঢেকে রাখতে আদেশ করা হবে, যাতে কুচরিত্রের লোকজন তাকে নিয়ে লালসা না করে।
সুত্র: আহকামুল কোরআন, ৩/৪৮৬।
ইমাম ইবনে জারির তার তাফসিরে তাবারিতে বলেন,
يا أيها النبي قل لأزواجك وبناتك ونساء المؤمنين: لا يتشبهن بالإماء في لباسهن إذا هن خرجن من بيوتهن لحاجتهن، فكشفن شعورهن ووجوههن. ولكن ليدنين عليهن من جلابيبهنّ؛ لئلا يعرض لهن فاسق، إذا علم أنهن حرائر، بأذى من قول.
হে নবি আপনি নিজের স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মুমিন নারীদের বলুন, তারা ঘর থেকে কোন প্রয়োজনে যখন বের হয় তখন যেন পোশাক-আশাকে দাসীদের সাদৃশ্য গ্রহণ না করে, দাসীদের মত নিজেদের চুল ও চেহারা খোলা না রাখে। বরং তারা যেন তাদের জিলবাব নিজেদের ওপর টেনে নেয়। যাতে করে তাদের স্বাধীন নারী হিসেবে জানা যায় এবং কোন পাপিষ্ঠের কাছ থেকে কষ্টদায়ক কথাবার্তার সম্মুখীন হতে না হয়।
লক্ষ্য করুন, ইবনে জারির আত তাবারি এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, পাপাচারীদের কষ্ট থেকে বাঁচতে নারীদের চেহারা ঢেকে রাখতে বলা হয়েছে। তিনি কিন্তু বলেন নি যে, এটাই নারীদের চেহারার ক্ষেত্রে মূল হুকুম। বরং সুরা নুরের ৩১ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় তিনি স্পষ্ট করেই বলেছেন যে, নারিদের চেহারা গোপন করে রাখা বাধ্যতামূলক না এবং তার জন্য চেহারা খোলা রাখার অনুমতি আছে।
ইবনে জারির বলেন,
وأولى الأقوال في ذلك بالصواب: قول من قال: عنى بذلك: الوجه والكفان، يدخل في ذلك إذا كان كذلك: الكحل، والخاتم، والسوار، والخضاب. وإنما قلنا ذلك أولى الأقوال في ذلك بالتأويل؛ لإجماع الجميع على أن على كلّ مصل أن يستر عورته في صلاته، وأن للمرأة أن تكشف وجهها وكفيها في صلاتها، وأن عليها أن تستر ما عدا ذلك من بدنها. فإذا كان ذلك من جميعهم إجماعا، كان معلوما بذلك أن لها أن تبدي من بدنها ما لم يكن عورة، كما ذلك للرجال; لأن ما لم يكن عورة فغير حرام إظهاره؛ وإذا كان لها إظهار ذلك، كان معلوما أنه مما استثناه الله تعالى ذكره، بقوله: ( إِلا مَا ظَهَرَ مِنْهَا ) لأن كل ذلك ظاهر منها.
এই আয়াতের সঠিকতম ব্যাখ্যা হল তাদের ব্যাখ্যা যারা বলেন, উন্মুক্ত করো না প্রকাশ্যমান যা তা ব্যাতীত এর উদ্দেশ্য হল চেহারা ও হাতের মুঠো। আর এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী এর মাঝে কাজল, আংটি, চুড়ি, মেহেদিও অন্তর্ভূক্ত হয়ে যায়। আমরা একে সঠিকতম ব্যাখ্যা বলেছি কারণ, সকলেই একমত যে, নামায পড়ার সময় আওরত বা গোপনীয় অঙ্গ ঢেকে রাখতে হয়। অথচ নারীর জন্য চেহারা ও হাতের মুঠো নামাযে খোলার রাখার অনুমতি আছে। এ দুই বাদে অন্যান্য অঙ্গ ঢেকে রাখা তার জন্য আবশ্যক। তাই যদি হয়, তাহলে এখান থেকে এটাও জানা গেল যে, শরীরের যেসব অংশ গোপনীয় নয় তা উন্মুক্ত করার অধিকার তার আছে, যেমনটি পুরুষের ক্ষেত্রে আছে। কারণ যা আওরত নয়, তা প্রকাশ করা হারাম নয়। তাই যেহেতু নারীদের এই অঙ্গ উন্মুক্ত করার অনুমতি আছে, তাই বোঝা গেল “যা প্রকাশ্যমান তা বাদে” বলে আল্লাহ এই অঙ্গকেই ব্যাতিক্রম করেছেন। কেননা এই অঙ্গের সবটাই প্রকাশ্যমান থাকে।
ইমাম ইবনে তায়মিয়্যাহ বলেন,
دَلِيلٌ عَلى أنَّ الحِجابَ إنّما أمَرَ بِهِ الحَرائِرَ دُونَ الإماءِ
এই আয়াত প্রমাণ করে যে, হিজাবের আদেশ কেবল স্বাধীন নারীদের জন্য, দাসীদের জন্য না।
সুত্র: মাজমুউল ফাতাওয়া, ১৫/৪৪৮
তিনি আরো বলেন,
والحِجابُ مُخْتَصٌّ بِالحَرائِرِ دُونَ الإماءِ كَما كانَتْ سُنَّةُ المُؤْمِنِينَ فِي زَمَنِ النَّبِيِّ ﷺ وخُلَفائِهِ أنَّ الحُرَّةَ تَحْتَجِبُ والأمَةُ تَبْرُزُ وكانَ عُمَر إذا رَأى أمَةً مُخْتَمِرَةً ضَرَبَها وقالَ أتَتَشَبَّهِينَ بِالحَرائِرِ أيْ لُكاعُ فَيَظْهَرُ مِن الأمَةِ رَأْسُها ويَداها ووَجْهُها.
হিজাবের আদেশ বিশেষভাবে কেবল স্বাধীন নারীদের জন্য, দাসীরা অন্তর্ভূক্ত নয়। নবি ও তার খলিফাদের যুগে মুমিনদের অভ্যাস ছিল, স্বাধীন নারীরা হিজাব করত, দাসীরা খোলামেলা থাকত। উমার এক দাসীকে পর্দাবৃত দেখে তাকে শাস্তি দেন এবং বলেন, রে গাধী! তুই কি স্বাধীন নারীদের মত সাজতে চাস? দাসীদের মাথা, দুই হাত ও চেহারা খোলা থাকত।
সুত্র: মাজমুউল ফাতাওয়া, ১৫/৩৭২।
ইমাম বায়হাকি উমারের ঘটনার ব্যাপারে মন্তব্য করেন,
والآثارُ عَنْ عُمَرَ بْنِ الخَطّابِ ﵁ فِي ذَلِكَ صَحِيحَةٌ، وإنَّها تَدُلُّ عَلى أنَّ رَأْسَها ورَقَبَتَها وما يَظْهَرُ مِنها فِي حالِ المِحْنَةِ لَيْسَ بِعَوْرَةٍ
উমারের ব্যাপারে বর্ণিত এই ঘটনা বিশুদ্ধ। এ থেকে প্রমাণ হয় দাসীদের মাথা, কাঁধ, এবং কাজের সময় অন্য যেসকল অঙ্গ উন্মুক্ত হয়, সেগুলো তাদের জন্য আওরত নয়।
সুত্র: আস সুনানুল কুবরা, ২/৩২০।
এই ঘটনার ব্যাখ্যায় খতিব শিরবিনি ‘মুগনিল মুহতাজ’ গ্রন্থে বলেন,
أنَّهُ - رَضِيَ اللَّهُ تَعالى عَنْهُ - قَصَدَ نَفْيَ الأذى عَنْ الحَرائِرِ؛ لِأنَّ الإماءَ كُنَّ يُقْصَدْنَ لِلزِّنا. قالَ - تَعالى -: ﴿ذَلِكَ أدْنى أنْ يُعْرَفْنَ فَلا يُؤْذَيْنَ﴾ وكانَتْ الحَرائِرُ تُعْرَفُ بِالسِّتْرِ فَخَشِيَ أنَّهُ إذا اسْتَتَرَتْ الإماءُ حَصَلَ الأذى لِلْحَرائِرِ، فَأمَرَ الإماءَ بِالتَّكَشُّفِ ويَحْتَرِزْنَ فِي الصِّيانَةِ مِن أهْلِ الفُجُورِ.
উমার রা. এই কাজের মাধ্যমে স্বাধীন নারীদের কষ্ট থেকে মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। কারণ দাসীদের ব্যাভিচারের জন্য টার্গেট করা হত। আল্লাহ বলেছেন, ‘এর মাধ্যমে তাদের চেনা সহজ হবে, ফলে তাদের উত্যক্ত করা হবে না’ স্বাধীন নারীরা তখন পরিচিত হত আবৃত থাকার মাধ্যমে। উমার ভয় করতেন যে, দাসীরা নিজেদের ঢেকে রাখা শুরু করলে স্বাধীন নারীরা কষ্টের মুখে পড়বে। তাই তিনি দাসীদের খোলামেলা থাকতে আদেশ করতেন যাতে পাপাচারীদের হাত থেকে স্বাধীন নারীরা সুরক্ষিত থাকে।
সুত্র: মুগনিল মুহতাজ, ৪/২১৩।
ইমাম ইবনে কাসির বলেন,
أَيْ إِذَا فَعَلْنَ ذَلِكَ عُرِفْنَ أَنَّهُنَّ حَرَائِرُ، لَسْنَ بِإِمَاءٍ وَلَا عَوَاهِرَ.
আয়াতের উদ্দেশ্য হল, নিজেদের ঢেকে রাখলে তাদের স্বাধীন নারী হিসেবে চেনা যাবে এবং বোঝা যাবে তারা দাসী কিংবা পতিতা নয়।
সুতরাং বোঝা গেল যে, আয়াতের উদ্দেশ্য হল অনিষ্টের হাত থেকে সতী-সাধ্বী নারীদের রক্ষা করা; আর এই উদ্দেশ্যেই জিলবাবকে নিজেদের দিকে টেনে নেয়ার আদেশ আল্লাহ এখানে দিয়েছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে জিলবাব পরিধান করলে অনিষ্টের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে?
ইবনে জারির বলেন,
ثم اختلف أهل التأويل في صفة الإدناء الذي أمرهن الله به فقال بعضهم: هو أن يغطين وجوههن ورءوسهن فلا يبدين منهن إلا عينا واحدة. وقال آخرون: بل أمرن أن يشددن جلابيبهن على جباههن
নারীদের যে টেনে নেয়ার আদেশ দেয়া হচ্ছে তা নিয়ে আয়াতের ব্যাখ্যাকাররা মতভেদ করেছেন, কীভাবে টেনে নিতে হবে। কেউ কেউ বলেছেন, তারা নিজেদের চেহারা ও মাথা ঢেকে রাখবে এবং কেবল এক চোখ খোলা রাখবে। অন্যরা বলেছেন, বরং নারীদেরকে শক্ত করে জিলবাবকে তাদের কপালে বেঁধে নিতে বলেছেন।
এই মতভেদটা তৈরি হয়েছে কারণ আয়াতে কেবল জিলবাব নিজেদের দিকে টেনে নিতে বলা হয়েছে; কতটুকু খোলা রাখলে কিংবা কতটুকু ঢেকে রাখলে, পাপিষ্ঠদের অনিষ্ট থেকে বাঁচা যাবে, তা নিয়ে কিছু আল্লাহ বলেন নি। মুফাসসিরগণ তাই চিন্তা করেছেন কতটুকু ঢেকে রাখলে সদ্দে যরিয়াহ অর্জন হবে, অর্থাৎ ক্ষতি ও অনিষ্ট থেকে বাঁচা সম্ভব হবে। আর এই বিষয়টা যেহেতু স্থান, কাল, পাত্র, পরিবেশের উপর নির্ভর করে, তাই কেবল একটি পদ্ধতিতে একে নির্দিষ্ট করা যায় নি।
ইমাম ফখরুদ্দিন রাযি তার তাফসিরে কাবিরে পুরো বিষয়টাকে এভাবে গুছিয়ে বলেছেন,
كانَ فِي الجاهِلِيَّةِ تَخْرُجُ الحُرَّةُ والأمَةُ مَكْشُوفاتٍ يَتْبَعُهُنَّ الزُّناةُ وتَقَعُ التُّهَمُ، فَأمَرَ اللَّهُ الحَرائِرَ بِالتَّجَلْبُبِ.
وقَوْلُهُ: ذلِكَ أدْنى أنْ يُعْرَفْنَ فَلا يُؤْذَيْنَ قِيلَ يُعْرَفْنَ أنَّهُنَّ حَرائِرُ فَلا يُتْبَعْنَ ويُمْكِنُ أنْ يُقالَ المُرادُ يُعْرَفْنَ أنَّهُنَّ لا يَزْنِينَ لِأنَّ مَن تَسْتُرُ وجْهَها مَعَ أنَّهُ لَيْسَ بِعَوْرَةٍ لا يُطْمَعُ فِيها أنَّها تَكْشِفُ عَوْرَتَها فَيُعْرَفْنَ أنَّهُنَّ مَسْتُوراتٌ لا يُمْكِنُ طَلَبُ الزِّنا مِنهُنَّ
জাহিলি যুগে স্বাধীন ও দাসী সব নারীরা খোলামেলাভাবে বের হত। আর ব্যাভিচারীর দল তাদের পিছু নিত। আর এর ফলে নানান অপবাদ তৈরি হত। ফলে আল্লাহ স্বাধীন নারীদের জিলবাব পরার আদেশ দেন। “চিহ্নিত করা যাবে, ফলে কষ্ট থেকে বাঁচবে” আয়াতের এই অংশের ব্যাপারে বলা হয়, তাদের স্বাধীন নারী বলে চেনা যাবে, ফলে তাদের পিছু নেয়া হবে না। আরও বলা যায়, চিহ্নিত করা যাবে যে, তারা ব্যাভিচারী নয়। কারণ আওরত বা গোপনীয় অঙ্গ না হওয়া সত্তেও যারা নিজেদের চেহারা ঢেকে রাখে, তাদের ব্যাপারে এই লালসা করা যায় না যে, সে নিজের গোপনীয় অঙ্গ উন্মোচন করবে! তাই চিহ্নিত করা যাবে যে, এই পর্দানশিন নারীদের সাথে ব্যাভিচারে লিপ্ত হওয়া সম্ভব না।
সুত্র: তাফসিরে কাবির, ২৫/১৮৪।
এই আলোচনা থেকে প্রমাণিত হল যে, ফুকাহারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে ফিতনা অর্থাৎ অঘটনের আশঙ্কায় চেহারা ঢাকার যে কথা আলোচনায় এনেছেন, তা মূল হুকুম হিসেবে আনেন নি, বরং সমসাময়িক সামাজিক বাস্তবতাকে বিবেচনা করেই বলেছেন। হানাফি মাযহাব দিয়েই উদাহরণ দেয়া যাক। দেওবন্দি ঘরানার বিখ্যাত হানাফি আলেম আনোয়ার শাহ কাশ্মীরী ফায়দ্বুল বারী গ্রন্থে লিখেছেন,
الزينة هي الوجه والكفان، فيجوز الكشف عند الأمن عن الفتنة على المذهب، وأفتى المتأخرون بسترها لسوء حال الناس
যিনাত হল চেহারা ও দুই হাতের মুঠো। ফিতনার আশংকা থেকে নিরাপদ থাকলে এই অঙ্গ খোলা রাখা হানাফি মাযহাব মতে জায়েয। তবে শেষ দিকের আলেমরা এগুলো ঢেকে রাখার ফতোয়া দিয়েছেন, মানুষের শোচনীয় অবস্থার কারণে।
সুত্র: ফায়দ্বুল বারী, ১/৩৪৮।
দেখুন, এটাই সেই ইলমি সততা যা আপনি আল কাওসারের মত পত্রিকায় পাবেন না। এই পত্রিকা আপনাকে বোঝাবে যে, শরিয়তের মূল বিধানই হচ্ছে চেহারা ঢেকে রাখতে হবে। সদ্দে যরিয়া নিয়ে আলাপের কোন বালাই তাদের নাই। সরাসরি চেহারা ঢেকে রাখাকে ফরজ বলবে এবং সেটা পূর্ণ অসততা ও খিয়ানতের সাথে হানাফি মাযহাব বলে চালিয়ে দিবে।
ফিতনার আশঙ্কা
হ্যাঁ, নারীদের চেহারা খোলা রাখার কারণে যদি তাদের ব্যাপারে ফিতনার আশঙ্কা তৈরি হয়, তাহলে আমরা অবশ্যই তাদের নিরাপত্তার খাতিরে চেহারা ঢাকতে বলব। এটাই তো সদ্দে যরিয়া। কিন্তু কথা হল, আল কাওসার পত্রিকা কেন নারীদের চেহারা নিয়েই এত প্যারানয়েড? শেষ দিকের হানাফি আলেমরা কি দাড়িহীন ছেলেদের ফিতনায় পড়ে সমকামিতায় লিপ্ত হওয়াকে এর চেয়ে মারাত্মক ফিতনা বলেন নি?
রদ্দুল মুহতারে ইবনে আবেদীন বলেন,
وَيُسْتَفَادُ مِنْ تَشْبِيهِ وَجْهِ الْمَرْأَةِ بِوَجْهِ الْأَمْرَدِ أَنَّ حُرْمَةَ النَّظَرِ إلَيْهِ بِشَهْوَةٍ أَعْظَمُ إثْمًا لِأَنَّ خَشْيَةَ الْفِتْنَةِ بِهِ أَعْظَمُ مِنْهَا وَلِأَنَّهُ لَا يَحِلُّ بِحَالٍ، بِخِلَافِ الْمَرْأَةِ
নারীর চেহারার সাথে দাড়িহীন ছেলের তুলনা দেয়ার কারণ হচ্ছে, দাড়িহীনের দিকে কামনা নিয়ে তাকানো নারীর দিকে কামনাবশত তাকানোর চাইতে বড় গুনাহ। কেননা তার ক্ষেত্রে ফিতনার আশংকা নারীর চাইতে মারাত্মক।
সুত্র: রদ্দুল মুহতার, ১/৪৩৯।
ইবনে আবেদীন সত্য বলেছেন নারীদের চেয়েও শ্মশ্রুহীন কিশোরদের ফিতনা মারাত্মক। আর এ কারণেই আমরা দেখি মাদ্রাসাগুলোতে সমকামিতা ও শিশু নিপীড়নের অগণিত ঘটনা। রদ্দুল মুহতারে আরো বলা হয়েছে, ফিতনার আশঙ্কা দুই প্রকারের হতে পারে — لِخَوْفِ الْفِتْنَةِ أَيْ الْفُجُورِ بِهَا أَوْ الشَّهْوَةِ নারীর নিপীড়িত হবার আশঙ্কা কিংবা তার ব্যাপারে কামোত্তেজনা তৈরি হওয়া। প্রথম প্রকারের ক্ষেত্রে, অর্থাৎ যেখানে নারীর নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার সম্ভাবনা রয়েছে, সেখানে চেহারা ঢেকে রাখার প্রসঙ্গ যৌক্তিক। কিন্তু কামভাব জাগ্রত হলে, সমাধান হল পুরুষের দৃষ্টি অবনত করা। নারীর চেহারা ঢাকা এখানে সমাধান নয়। কারণ পুরুষের জন্য কামভাবের সাথে নারীর পোশাকের দিকে তাকানোও হারাম! এখন পুরুষের কুদৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য নারীকে কি সবসময় পালকির ভেতরে থেকে ঘোরাফেরা করতে বলব? কেন একজনের সমস্যা, আরেকজনের ওপর চাপানো হবে? আর অন্তরে কামভাব তো বাহ্যিকভাবে জানার কোন উপায় নেই। এমন বিষয়ের উপর শরিয়তের কোন হুকুমকে কীভাবে সংযুক্ত করা সম্ভব যা বাহ্যিকভাবে নির্ণয় করা কারো পক্ষে সম্ভব না?
নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া ও অঘটনের যেই কথা ইবনে আবেদীন উল্লেখ করেছেন, সেটাই মূলত হানাফি মাযহাব অনুযায়ী ফিতনার আশঙ্কায় চেহারা ঢেকে ঘর থেকে বের হওয়া এবং সুরা আহযাবের ৫৯ নং আয়াতের ব্যাখ্যা। আর সামাজিক নিরাপত্তা যেহেতু কোন ধ্রুব ও অপরিবর্তনীয় বিষয় নয়, স্থান, কাল, পাত্র ও পরিবেশ অনুযায়ী এটি পরিবর্তন হয়। তাই এমন একটি বিষয়ের ক্ষেত্রে কোন ব্ল্যাংকেট স্টেটমেন্ট দেয়া যাবে না। বরং সবসময়ই খতিয়ে দেখতে হবে যে, কোথায় কোথায় এই নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে, সেখানে চেহারা ঢেকে রাখতে বলা হবে। কোথায় কোথায় নারীর নিরাপত্তা ও কোন অঘটন ঘটা নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই, সেখানে অনুমতি দিতে হবে। আর এটাই প্রকৃত ফিকহের পরিচয়। স্থান-কাল-পাত্রকে বিবেচনায় না নেয়া হল ধর্মে গোমরাহির নামান্তর।
ইমাম আল কারাফি বিষয়টি সুন্দর ভাবে বুঝিয়ে লিখেছেন। তিনি বলেন,
إن الأحكام المترتبة على العوائد تدور معها كيفما دارت وتبطل معها إذا بطلت، كالنقود في المعاملات، والعيوب في الأعراض، ونحو ذلك، فلو تغيرت العادة في النقد والسكَّة إلى سكَّة أخرى يحمل الثمن في البيع على السكَّة التي تجددت العادة بها، دون ما قبلها، وعلى هذا القانون تراعى الفتاوي على طول الأيام، فمهما تجدد العرف فاعتبِرْهُ، ومهما سقط فأسقطْه ولا تجمد على المسطور في الكتب طول عمرك، بل إذا جاء رجل من غير أهل إقليمك يستفتيك لا تُجْرِه على عرف بلدك، واسأل عن عرف بلده وأجْرِهِ عليه وأفته به دون عرف بلدك والمقرر في كتبك، فهذا هو الحق الواضح، والجمود على المنقولات أبدًا ضلال في الدين وجهل بمقاصد علماء المسلمين والسلف الماضين
যেসব হুকুম মানুষের আদত বা সামাজিক অবস্থার সাথে যুক্ত; সেসব হুকুম আদত অনুযায়ী নির্ধারিত হয়, আদত চলে গেলে হুকুমও চলে যায়। যেমন লেনদেনের ক্ষেত্রে মুদ্রার, পণ্যের ক্ষেত্রে ত্রুটি। যদি পয়সা বা মুদ্রার ক্ষেত্রে আদত পাল্টে যায়, এক মুদ্রা থেকে অন্য মুদ্রার আদত বা প্রচলন শুরু হয়, তবে বিক্রির সময় নতুন মুদ্রার পণ্যের লেনদেন করতে হবে, আগেরটা দিয়ে নয়। আর এই কানুন সারাজীবন ফতওয়া প্রদানের ক্ষেত্রে রক্ষা করবে। যখনই আদত-অভ্যাস নতুনত্ব আসবে, তখনই সেটাকে বিবেচনায় নিবে। যখনই কোন আদত হারিয়ে যাবে, তখন সেটা বিবেচনা করাও বাদ দিবে। বইয়ের পাতায় কী লেখা আছে, তা নিয়ে সারাজীবন জমাট বেঁধে থাকবে না। যখনই তোমার কাছে ভিন্ন অঞ্চল থেকে কেউ ফতোয়ার জন্য আসবে, তার ব্যাপারে তুমি নিজ অঞ্চলের সামাজিক অবস্থা অনুযায়ী ফতোয়া দিবে না। বরং তার দেশের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে এবং সে অনুযায়ী ফতোয়া দিবে। বইতে কী লেখা আছে সেটা অনুযায়ী দিবে না। এটাই হল সত্য ও স্পষ্ট বিষয়। সদাসর্বদা লিখিত উক্তির উপর জড়তাবদ্ধ হয়ে থাকা ধর্মে গোমরাহির কারণ, মুসলিম আলেমদের উদ্দেশ্য ও পূর্বে বিগত সালাফদের মাকসাদ সম্পর্কে অজ্ঞতার পরিচয়।
সুত্র: আল ফুরুক, ১/৩১৪।
সমাপ্ত