মালিকি মাযহাব অনুযায়ী দাবা খেলার হুকুম – ইমাম ইবনে আব্দুল বার।
মালিকি মাযহাব অনুযায়ী দাবা খেলা মৌলিকভাবে হারাম নয়।
ইমাম মালিকের মুয়াত্তা শরিফের সবচাইতে বিখ্যাত ব্যাখ্যাগ্রন্থ হল হাফেযুল মাগরেব ইমাম আবু উমার ইবনে আব্দুল বার আল-কুরতুবি আল-মালিকি (রহিমাহুল্লাহ) রচিত “আত-তামহীদ” গ্রন্থ। মুয়াত্তায় ইমাম মালিক লুডু (নারদ) ও দাবা (শতরঞ্জ) নিয়ে আলোচনা করেছেন। ইমাম ইবনে আব্দুল বার এর পরিপ্রেক্ষিতে যা লিখেছেন তা নিচে অনুবাদ করা হল।
« ইবনে ওয়াহব বলেছেন, আমাকে মালিক বিন আনাস বলেছেন, আলকামা বিন আবি আলকামা থেকে, তিনি তার মা থেকে, তিনি নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) এর স্ত্রী আয়েশা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) থেকে যে, হযরত আয়েশার কাছে খবর গেল যে তার বাড়িতে এক ঘরে কিছু মানুষের কাছে নারদ আছে। তিনি লোক পাঠিয়ে বললেন যে, “যদি তাদেরকে তোমরা বের না করো, খোদ আমি গিয়ে তাদেরকে ঘর থেকে বের করে দিব এবং তাদের নিন্দা করে আসব।”
আবু উমার বলেন, আলেমদের মাঝে নারদ খেলা নিয়ে ইখতেলাফ আছে। ইমাম মালিক একে মাকরুহ বলেছেন যেমনটি আমরা তার থেকে উল্লেখ করেছি। তার সঙ্গীদের কেউ এর মাকরুহ হবার ব্যাপারে মতভেদ করেনি। ইবনে ওয়াহব নারদের পাশাপাশি দাবা খেলা মাকরুহ হবার কথাও ইবনে ওমর, আয়েশা, আবু মুসা আশআরি, কাসেম বিন মুহাম্মদ, সাইদ বিন মুসাইয়াব এবং অন্যদের থেকে। তাদের বক্তব্যে ব্যবহৃত শব্দ থেকে বোঝা যায় যে, তারা এটা কেবল জুয়ার সাথে জড়িত হবার ক্ষেত্রে মাকরুহ বলেছেন।
শাফেয়ী বলেছেন, আমি নারদ খেলা অপছন্দ করি যেহেতু এই ব্যাপারে হাদিস আছে। আর দাবা ও কবুতর নিয়ে যারা জুয়া ব্যাতিরেকে খেলে তাদের কাজকেও অপছন্দ করি, তবে এগুলো নারদ খেলার চাইতে হালকা বিষয়।
আবু হানিফা ও তার সঙ্গীদের মতে দাবা, নারদ, চৌদ্দগুটি এবং সকল প্রকার খেলাধুলা মাকরুহ। যারা এসব খেলে তারা যদি কোন কবিরা গুনাহে লিপ্ত না থাকে এবং তাদের নেককাজ বদকাজের তুলনায় বেশি হয় তবে তাদের সাক্ষ্য আদালতে কবুল করা হবে। মালিক ও তার সঙ্গীদের মতও কাছাকাছি; তবে সাক্ষ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে তাদের মাযহাব হল নারদ খেলোয়াড়ের সাক্ষ্য কবুল করা হবে না, আর যারা দাবা খেলায় সর্বক্ষণ মশগুল থাকে তাদের সাক্ষ্যও কবুল করা হবে না। তবে মালিকিদের কেউ কেউ বলেছেন, নারদ ও দাবা খেলায় পার্থক্য নেই, উভয়ক্ষেত্রেই কেবল তাদের সাক্ষ্য পরিত্যাগ করা হবে যারা সারাক্ষণ খেলে। এদিকে মালিকিদের কেউ কেউ বলেছেন, দাবা খেলা নারদ খেলার চাইতে খারাপ, তাই নারদের অনুরূপভাবে দাবা খেলোয়াড়ের সাক্ষ্যও বাতিল করা হবে, চাই সে সারাক্ষণ এই খেলায় লিপ্ত না থাকুক। এই শেষোক্ত মতটি লাইস বিন সাদেরও মত যা ইবনে ওয়াহব তার থেকে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, দাবা খেলায় কোন কল্যাণ নেই, এটা নারদের চাইতেও খারাপ। ইবনে শিহাব বলেছেন, এটা বাতিল কাজ এবং আমি এটা পছন্দ করি না। ইবনে ওয়াহব এটা উল্লেখ করেছেন ইয়াহিয়া বিন আইউব থেকে, তিনি আকিল থেকে, তিনি ইবনে শিহাব থেকে। এদিকে শাফেঈর মাযহাবের ব্যাপারে তার সঙ্গীদের মত হল, নারদ অথবা দাবা খেলোয়াড় যদি সকল বিষয়ে ন্যায়পরায়ণ হয় এবং তার ব্যাপারে কোন কবিরা গুনাহ, নির্বুদ্ধিতা ও সন্দেহজনক কিছু প্রকাশ না পায়, তাহলে তার সাক্ষ্য কবুল করা হবে। তবে যদি এসব নিয়ে জুয়া খেলে কিংবা এরকম প্রসিদ্ধি থাকে তবে তাকে আর ন্যায়পরায়ণ বলে বিবেচনা করা হবে না এবং নির্বোধ হিসেবে গণ্য করা হবে যেহেতু সে বাতিল উপায়ে টাকা খেয়েছে।
আলেমদের মাঝে এই নিয়ে কোন মতভেদ নেই যে, জুয়া খেলা কোরআনে নিষিদ্ধ “মায়সির” এর অন্তর্ভূক্ত। তবে অধিকাংশ আলেমের মত হল নারদ খেলা সর্বাসবস্থায় মাকরুহ এবং আমার জানামতে অল্প কয়েকজন বাদে কেউ এর ব্যাপারে ছাড় দেন নি। যারা ছাড় দিয়েছেন তাদের মাঝে আব্দুল্লাহ বিন মুগাফফাল, ইকরিমা, শা’বি, সাইদ বিন মুসাইয়াবের উল্লেখ পাওয়া যায়। এদিকে শু’বা থেকে ইয়াজিদ বিন আবি খালিদ বর্ণনা করেন, আমি আব্দুল্লাহ বিন মুগাফফালের ঘরে প্রবেশ করে দেখলাম তিনি তার স্ত্রীর সাথে কাঠি দিয়ে নারদশির খেলছেন। ইকরিমা ও শা’বী থেকে বর্ণিত আছে, তারা দুইজনে নারদ দিয়ে খেলতেন। ইবনে কুতাইবা ইসহাক বিন রাহাওয়াইহ থেকে, তিনি নাদ্বর বিন শুমাইল থেকে, তিনি শু’বা থেকে, তিনি আব্দু রব্বিহি থেকে বর্ণনা করেছেন, আমি সাইদ বিন মুসাইয়াবকে নারদ সম্পর্কে বলতে শুনেছি, যদি জুয়ার উদ্দেশ্যে না হয়, তবে সমস্যা নেই। ইসহাক বলেন, যদি জুয়া ব্যাতিরেকে প্রশিক্ষণ ও কৌশল চর্চার জন্য খেলে তবে মাকরুহ হবে, কিন্তু সাক্ষ্য বাতিল করার পর্যায়ে পৌঁছবে না।
আবু উমার (ইমাম ইবনে আব্দুল বার) বলেন, নবীজী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) থেকে সাবেত আছে যে, তিনি নারদ খেলতে নিষেধ করেছেন এবং তিনি জানিয়েছেন যে, এই কাজে লিপ্ত ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের অবাধ্য। সুতরাং যারা এর বিপরীত বলেছেন তাদের কথার কোন অর্থ নেই। কারণ সুন্নাহর বিপরীত কথা যে বলবে তার বিপক্ষে সুন্নাহকে প্রমাণ হিসেবে ধরা হবে। আর সুন্নাহকে অনুসরণ করাই হক, এর বরখেলাফ করা গোমরাহি। তবে হ্যাঁ, এই ব্যাখ্যার সুযোগ আছে যে, এই নিষেধাজ্ঞা জুয়া হিসেবে খেলার ক্ষেত্রে এসেছে। তবে সর্বোচ্চ সতর্কতা হল, এই নিষেধকে জুয়া হোক কিংবা জুয়া ছাড়া সকল পরিস্থিতিতে ব্যাপক রাখা। ইনশাআল্লাহ। আমাদের আব্দুল ওয়ারিস বিন সুফিয়ান বলেছেন, আমাদের কাসিম বিন আসবাগ বলেছেন, আমাদের ইবনে ওয়াদ্দাহ বলেছেন, আমাদের মুসা বিন মুয়াবিয়ার বলেছেন, আমাদের ওয়াকি বিন ফাদ্বল বিন দালহাম বলেছেন, তিনি বলেন, হাসান বসরী বলতেন, নারদ হল অনারবদের মায়সির।
তবে দাবা খেলার ব্যাপারে কথা হচ্ছে, এই নিয়ে আলেমদের মতভেদ নারদ নিয়ে তাদের মতভেদের সমান পর্যায়ের না। কারণ বহুসংখ্যক আলেম জুয়ামুক্ত হলে দাবা খেলার অনুমতি দিয়েছেন যাদের মধ্যে আছেন—সাইদ বিন মুসাইয়াব, সাইদ বিন জুবাইর, মুহাম্মদ বিন সিরিন, মুহাম্মদ বিন মুনকাদির, উরওয়া বিন যুবাইর, তার পুত্র হিশাম, সুলাইমান বিন ইয়াসার, আবু ওয়ায়েল, শা’বী, হাসান বসরী, আলী বিন হাসান বিন আলী, জাফর সাদেক, ইবনে শিহাব, রবিয়াহ, আতা। তাদের সবাই জুয়া ব্যতিরেকে দাবা খেলার অনুমতি দিয়েছেন। তবে সাইদ বিন মুসাইয়াব থেকে বর্ণনা পাওয়া যায় যেখানে তিনি দাবা খেলাকে মায়সির আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু আমাদের মতে, একে জুয়া খেলার অর্থে ব্যাখ্যা করতে হবে যাতে তার সূত্রে আগত বর্ণনাসমূহের মাঝে সাংঘর্ষিকতা তৈরি না হয়। আলেমদের কোন মতভেদ নেই যে, জুয়ার উদ্দেশ্যে দাবা খেলা এবং এর মাধ্যমে অর্জিত টাকা ভোগ করা বৈধ না এবং এটা নিষিদ্ধ মায়সিরের অন্তর্ভূক্ত। আর যে এর মাধ্যমে প্রসিদ্ধি লাভ করে সে নির্বোধ এবং তার সাক্ষ্য গ্রহণ করা জায়েয না। ওয়ালিদ বিন মুসলিম বর্ণনা করে বলেছেন, আমাদের আওযাই বলেছেন, যুহরী থেকে, তিনি হুমাইদ বিন আব্দির রহমান বিন আওফ থেকে, তিনি আবু হুরায়রা থেকে যে, আল্লাহর রাসুল (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার ভাইকে জুয়া খেলতে ডাকে, সে যেন সদকা করে। ওয়ালিদ বলেন, আমি আওযাইকে বলতে শুনেছি, যদি তারা দুইজনে টাকা দিয়ে জুয়া খেলে তবে এই টাকা তাদের জন্য হারাম এবং তাদের এটা সদকা করে দিতে হবে। যদি এই জুয়াতে দাস মুক্ত করার শর্ত থাকে, তবে এটা বাস্তবায়ন করা হবে।
আমাদের সালত বিন সাউদ বলেছেন, আমাদের হাম্মাদ বিন যায়দ বলেছেন, হিশাম থেকে, তিনি মুহাম্মদ বিন সিরিন থেকে যে, তিনি দাবা খেলায় সমস্যা দেখতেন না যদি এতে জুয়া না থাকত।
আমাদের খালাফ বিন কাসেম বলেছেন, আমাদের মুহাম্মদ বিন হারুন আল-জাওহারি বলেছেন, আমাদের ইবনে রাশদিন বলেছেন, আমাদের ইবনে বুকাইর বলেছেন, আমাদের ইবনে লুহাইয়াহ বলেছেন, আমাদের উকাইল বলেছেন, আমাদের ইবনে শিহাব বলেচেহেন, দাবা খেলায় সমস্যা নেই যদি জুয়া না থাকে।
ওয়াকি বর্ণনা করেছেন সুফিয়ান থেকে, তিনি লাইস থেকে, তিনি মুজাহিদ, তাউস ও আতা থেকে যে, তারা তিনজন বলেছেন, যেকোন বিষয় যাতে জুয়া থাকে, তা মায়সিরের অন্তর্ভূক্ত এমনকি সেটা শিশুদের আখরোট নিয়ে খেলা হলেও।
ওয়াকি সুফিয়ান থেকে, তিনি মুগিরা থেকে, তিনি ইব্রাহিম নাখয়ি থেকে অনুরূপ বর্ণনা করেছেন।
ইমাম মালিকের মাযহাব ও জুমহুর ফুকাহার বক্তব্যের খোলাসা হল, দাবা খেলায় যদি জুয়া না থাকে এবং কেউ যদি নিজের পরিবারের সাথে ঘরের আড়ালে খেলে—মাসে একবার কিংবা বছরে একবার—আর এর খবর প্রকাশ না পায়, তবে এটা উপেক্ষা করা হবে, এটা না তার জন্য হারাম, না মাকরুহ। কিন্তু যদি সে উচ্ছণ্ণ হয়ে যায় এবং মাতামাতি করে তবে তার মুরুয়াহ (ব্যক্তিত্বশীলতা), আদালাত (ন্যায়পরায়ণতা) নষ্ট হয়ে যাবে এবং তার সাক্ষ্য বর্জন করা হবে। এখান থেকে বুঝতেই পারছ যে, দাবা খেলা সত্ত্বাগতভাবে স্বয়ং হারাম কাজ নয়। কারণ যা সত্ত্বাগতভাবে হারাম তাতে অল্প-বেশির পার্থক্য করা হয় না। দাবা খেলা এমন কোন জরুরি পরিস্থিতি নয় যে এর কারণে অন্যান্য হারামের মত নিরুপায় হয়ে করার কারণে ছাড় দেওয়া হয়েছে। মূলত এমন খেলাধুলা থেকে কেউই সম্পূর্ণ মুক্ত থাকতে পারে না, তাই অল্প পরিমাণে করলে মার্জনা করা হয়েছে।»
হাফেয ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহিমাহুল্লাহ’র আত-তামহীদ কিতাবের ৮ম খণ্ডের ২৭৭-২৮১ পৃষ্ঠা থেকে অনূদিত।