বিবর্তনতত্ত্ব ও ইসলামের সমঝোতা নিয়ে কথা বলার জন্য আমাদের আগে এপিস্টেমোলোজি বা জ্ঞানতত্ত্ব নিয়ে চিন্তা করা উচিত। বিবর্তনতত্ত্ব একটা প্রস্তাবনা আমাদের সামনে উপস্থাপন করছে। যেকোন প্রস্তাবনা হয়ত সত্য হবে কিংবা মিথ্যা। এখন কোন একটা প্রস্তাবনা (কথা) সত্য নাকি মিথ্যা এই জ্ঞান লাভের উপায় কী?
ইসলামি ধর্মতত্ত্বে এই নিয়ে বিস্তর আলাপ হয়েছে, তবে আকিদায়ে নাসাফিয়ার ভাষায় সংক্ষেপে বললে —
وأسباب العلم للخلق ثلاثة: الحواس السليمة، والخبر الصادق، والعقل
"মানুষের জন্য জ্ঞান লাভের উৎস তিনটি: সুস্থ ইন্দ্রিয়, সত্য সংবাদ ও যুক্তি।"
তো এই তিন উৎসের মধ্যে ইন্দ্রিয় ও সংবাদ এমন দুটি উৎস যা আমাদের জ্ঞানের কাচামাল সরবরাহ করে। আর যুক্তিবুদ্ধি ইন্দ্রিয় ও সত্য সংবাদ থেকে নতুন জ্ঞান উদঘাটন করে। উদাহরণ দেয়া যাক। আপনি হাড়িতে পানি রেখে চুলায় গরম করা শুরু করলেন। একটা থার্মোমিটারের মাধ্যমে পরিমাপ করলেন যে, ১০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় পানি ফোটা শুরু করেছে। আপনি এই পরীক্ষা কয়েকশ বার করলেন। প্রত্যেকবার একই ফলাফল পেলেন। আপনার অনেক বন্ধুও একই ফলাফল পেয়ে আপনাকে জানাল। এখান থেকে আপনি উপসংহারে পৌঁছলেন যে, পানি ফোটা ও ১০০ ডিগ্রি তাপমাত্রার সম্পর্কটা কাকতালীয় নয়। এই উভয়ের মধ্যে কার্যকারণগত সম্পর্ক আছে। আপনি জ্ঞান লাভ করলেন। এই পুরো প্রক্রিয়ার জ্ঞানের তিনটি উৎসই কাজে এসেছে। আপনার পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণে আপনি নিজের ইন্দ্রিয় যেমন চোখের সাহায্য নিয়েছেন। বন্ধুর কাছ থেকে সত্য সংবাদ পেয়েছেন। অতঃপর এসবের মিশেলে যুক্তিবুদ্ধি অনুযায়ী একটা জ্ঞান অর্জন করেছেন।
এবার আসা যাক এই নতুন জ্ঞানের শক্তিমত্তা নিয়ে। আপনি ও আপনার বন্ধুরা যেহেতু সীমিত সংখ্যক পরীক্ষা ও পর্যবেক্ষণ থেকে জেনারেলাইজড তথা সার্বিক ও সামগ্রিক একটা দাবি করেছেন, তাই আপনার দাবির পেছনে থাকা জ্ঞানগত ভিত্তি কিছুটা দুর্বল। এমনও হওয়া তো সম্ভব যে, আপনারা ১০০টা সাদা হাস দেখে মন্তব্য করলেন, হাস মানেই সাদা; কিন্তু বাস্তবে কালো হাসও আছে যা আপনি দেখেন নি। তাই আপনার দাবি মিথ্যা হবার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু মানুষ হিসেবে আমরা যেহেতু সীমাবদ্ধ তাই আমাদের ব্যবহারিক প্রয়োজন মেটাতে আমাদের সীমাবদ্ধ পর্যবেক্ষণ দিয়েই কাজ চালাতে হয়। তাই যথেষ্ট বড় স্যাম্পল পপুলেশন এর ওপর পরীক্ষা চালানো হলে, আমরা ধরে নিতে পারি আমাদের পরীক্ষার ফলাফল সঠিক। কিন্তু জ্ঞানতত্ত্বের জায়গা থেকে এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে, আমাদের টানা উপসংহারের ব্যতিক্রম থাকতে পারে।
তো এই দীর্ঘ ভূমিকা অবতারণা করার কারণ হল – বিবর্তনতত্ত্বের দুইটি মাত্রা সম্পর্কে বোঝা। হ্যাঁ, যেহেতু এটা সীমিত পর্যবেক্ষণ এবং বিভিন্ন অনুমানের ওপর নির্ভর করে তৈরি করা তত্ত্ব, তাই এই জ্ঞানতত্ত্বের দিক থেকে এর মাঝে দুর্বলতা অবশ্যই আছে। কিন্তু আবার এটাও বিবেচ্য যে, এই তত্ত্বের মাধ্যমে যদি আমাদের সকল পর্যবেক্ষণকে কোন রকম অসংলগ্নতা ছাড়া ব্যাখ্যা করা যায়, তবে এই তত্ত্বটি 'ইনফারেন্স টু দ্যা বেস্ট এক্সপ্ল্যানেশন" বা সবচেয়ে ভালো ব্যাখ্যা হবার কারণে সকল ব্যবহারিক ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য। অর্থাৎ কোন একটি ব্যাখ্যা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হবার জন্য তাকে জ্ঞানতাত্ত্বিক সকল দুর্বলতা থেকে মুক্ত হওয়া জরুরি না।
এবার ইসলামের দিকে আসা যাক। জনমনে ধারণা আছে যে, কোরআন হাদিসে মানবজাতির যেই আখ্যান দেয়া হয়েছে তা বিবর্তনের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। কারণ বিবর্তন বলছে, পৃথিবীপৃষ্ঠে বিদ্যমান কোন প্রজাতি শূন্য থেকে আবির্ভূত হয় নি। সবাই ধীরে ধীরে পরিবর্তিত ও উন্নত হয়েছে। মানবজাতিও ভিন্ন নয়। আধুনিক মানুষের আগেও মানুষের কাছাকাছি প্রজাতি ছিল যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম বিভিন্ন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। অতঃপর আধুনিক মানুষের আবির্ভাব হয়েছে। আর এদিকে কোরআন বলছে, প্রথম আধুনিক মানুষ আদম আর আদমকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর এর প্রচলিত ব্যাখ্যা হল, মাটি থেকে সরাসরি পিতামাতা ছাড়া সৃষ্টি করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোরআনের আয়াতগুলো আরবী ভাষা ও ব্যাকরণ ঠিক রেখে কি এই একটা উপায়েই ব্যাখ্যা করা যায়? নাকি এর অন্য কোন ব্যাখ্যাও সম্ভব? এখন কেউ যদি বলেন যে, এই ভিন্ন ব্যাখ্যা তো আগে কেউ করেন নি, আমরা কিভাবে করি? তো এর উত্তর হল: প্রচলিত ব্যাখ্যাটাও তো ওহী নয়। বরং তৎকালীন বাস্তবতা ও প্রচলিত ধ্যানধারণা দ্বারা প্রভাবিত। ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মের ব্যাখ্যা দ্বারাও প্রভাবিত। এইগুলো কি অকাট্য সত্য জ্ঞানের উৎস? পৃথিবী সমতল, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, সমুদ্রে মৎসকন্যা আছে এগুলোও তো মানুষ বিশ্বাস করত। সহজ কথায় ওহী ও মানবীয় ইজতিহাদকে আলাদা করা শিখতে হবে।
এবার ধরা যাক যে, কোরআন ও হাদীসকে এমনভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব যা বর্তমান বিবর্তনতত্ত্বের সাথে মেলে। এমন ক্ষেত্রে কি আমরা বিজ্ঞানের দোহাই তুলে এই ব্যাখ্যাকেই কোরআনের সঠিক ব্যাখ্যা দাবি করব এবং বিপরীত ব্যাখ্যাকে ভুল বলব? এর উত্তরও আমাদের জ্ঞানতাত্ত্বিক উপায়ে দিতে হবে। মনে করুন, আপনার কাছে একটা দাড়িপাল্লা আছে। এক পাল্লায় আপনি বিবর্তনতত্ত্বকে রাখলেন এবং তার ওজন (জ্ঞানগত শক্তি) মাপলেন, আরেক পাল্লায় রাখলেন ক্রিয়েশনিজম থিওরি (পিতামাতা ছাড়া আদমের আবির্ভাব)। যদি দেখেন যে, ক্রিয়েশনিজম থিওরি যা কিনা কোরআনের সরল ও সহজ ব্যাখ্যাকে হারানোর মত পর্যাপ্ত ওজন জ্ঞানগতভাবে বিবর্তনতত্ত্বের নেই, তাহলে বিবর্তনকে রক্ষা করতে গিয়ে কোরআনের সরল ব্যাখ্যা ত্যাগ করা বোকামি হবে। কিন্তু যদি দেখা যায় যে, বিবর্তন তত্ত্বের ওজনই বেশি, তাহলে কোরআনের এমন ব্যাখ্যাকেই বেছে নিবেন যা এর সাথে মানানসই হয়। এর জন্য যদি একটু কঠিন ও জটিল ব্যাখ্যা গ্রহণ করা প্রয়োজন হয়, তবে কোন সমস্যা নেই।
ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেন,
وأما إن كانا ظنيين فإنه يصار إلى طلب ترجيح أحدهما، فأيهما ترجح كان هو المقدم سواء كان سمعيًّا أو عقليًّا
“যদি দুইটি পরস্পর বিরোধী জ্ঞানসুত্র বা দলিলের উভয়েরই সঠিক হওয়া সম্ভাবনা থাকে, তাহলে খোঁজ করা হবে কোনটা বেশি শক্তিশালী। অতঃপর যেটাই বেশি শক্তিশালী হবে, সেটাই প্রাধান্য দেয়া হবে — হোক সেটা ধর্মীয় পাঠনির্ভর, হোক সেটা যুক্তিবুদ্ধিনির্ভর।”
বিবর্তনতত্ত্ব ও ইসলামের মাঝে তাই বোঝাপড়া সম্ভব কিনা এটা মূলত বিবর্তনতত্ত্বের উপরই নির্ভর করছে। যদি বিবর্তনতত্ত্ব নিজেকে এমনভাবে প্রমাণ করতে পারে যা নিয়ে যুক্তিবুদ্ধি দিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগ থাকে না, তবে একে গ্রহণ করে নিতে ইসলামের কোন সমস্যা থাকবে না। কারণ কোরআন ও সহীহ হাদীসে সৃষ্টির সূচনা সংক্রান্ত বয়ানগুলোর একাধিক ব্যাখ্যা সম্ভব। যাহেরি বা সহজ সরল ব্যাখ্যায় আমরা অটল থাকব নাকি তুলনামূলক জটিল ব্যাখ্যার দিকে যাব, সেটা তাই বিবর্তনতত্ত্বের জ্ঞানতাত্ত্বিক শক্তিমত্তার উপর নির্ভরশীল।
ইসলামি ধর্মতাত্ত্বিকদের জন্য বিবর্তন কখনোই আতঙ্কের কারণ হতে পারে না। আমরা অতীতে এর চেয়ে অনেক কঠিন প্রবলেম সলভ করে এসেছি। আল্লাহর যাত ও সিফাত নিয়ে আকল (বুদ্ধি) ও নকলের (পাঠ) বোঝাপড়া নিয়ে আমাদের ডাইভার্স ও সুবিস্তৃত ঐতিহ্য আছে। তাই বিবর্তনতত্ত্ব কখনোই আমাদের অস্তিত্ব সংকটে ফেলতে পারবে না।
প্রসঙ্গক্রমে ইমাম ফখরুদ্দিন রাযির বক্তব্য উল্লেখ করি। তিনি বলেন,
وأما الظَّواهِر النقلية المشعرة بالجسمية والجهة فالجَواب الكُلِّي عَنْها أن القواطع العَقْلِيَّة دلّت على امْتناع الجسمية والجهة والظواهر النقلية مشعرة بِحُصُول هَذا المَعْنى والجمع بَين تصديقهما محال وإلّا لزم اجْتِماع النقيضين والجمع بَين تكذيبهما محال وإلّا لزم الخُلُو عَن النقيضين والقَوْل بترجيح الظَّواهِر النقلية على القواطع العَقْلِيَّة محال لِأن النَّقْل فرع على العقل فالقدح فِي الأصْل لتصحيح الفَرْع يُوجب القدح فِي الأصْل والفرع مَعًا وهُوَ باطِل فَلم يبْق إلّا الإقْرار بِمُقْتَضى الدَّلائِل العَقْلِيَّة القطعية وحمل الظَّواهِر النقلية إمّا على التَّأْوِيل وإمّا على تَفْوِيض علمها إلى الله سُبْحانَهُ وتَعالى وهُوَ الحق
"কোরআন হাদিসের বাহ্যিক "পাঠ" থেকে যদি আল্লাহর শরীর ও দিকের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তবে এর জবাব হবে — অকাট্য যৌক্তিক উপসংহার থেকে আমরা জানি আল্লাহর জন্য শরীর ও দিক থাকা অসম্ভব। অন্যদিকে বাহ্যিক পাঠ বলছে, সম্ভব। আর এই দুই সাংঘর্ষিক বক্তব্যের উভয়ের একইসাথে সঠিক হওয়া তো সম্ভব না। আবার দুইটাও একইসাথে বেঠিক হওয়া সম্ভব না। সুতরাং কোন একটাকে অন্যটার ওপর স্থান দিতে হবে। এখন বাহ্যিক পাঠকে অকাট্য যুক্তি ওপর স্থান দেয়া অসম্ভব কারণ যেই ধর্মীয় বিশ্বাস থেকে এই "পাঠ" উৎসারিত হয়েছে, সেটা নিজেই যুক্তিবুদ্ধির আলোকে গৃহীত উপসংহারের একটি শাখা। অর্থাৎ যুক্তি হচ্ছে গাছের শেকড়, আর "পাঠ" হচ্ছে গাছের শাখা। যদি শাখা ঠিক রাখতে গিয়ে শেকড় উপড়ে ফেলা হয়, তাহলে শেকড় ও শাখা দুটোই উপড়ে ফেলা হবে। আর এটা বাতিল, এটা করার কোন সুযোগ নেই। সুতরাং পথ কেবল একটাই থাকছে, তা হল — অকাট্য যৌক্তিক উপসংহারকে নিজ জায়গায় ঠিক রাখতে হবে এবং বাহ্যিক পাঠকে এর সাথে সঙ্গতি রেখে ব্যাখ্যা করতে হবে অথবা এই পাঠের সঠিক ব্যাখ্যা কী হবে তার জ্ঞান আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে দিতে হবে। আর এটাই সঠিক পথ।"
— রাযী, মাআলিমু উসুলিদ দীন (ধর্মীয় মূলনীতির রূপরেখা)
প্রচলিত ব্যাখ্যার বাইরে কোরআনের ভিন্ন পাঠ কীভাবে হতে পারে তা এই ভিডিও থেকে ধারণা নিতে পারেন।